স্মার্টফোন এবং ট্যাবলেট: ক্রমশ কাছাকাছি

|
পর্দার মাপ বেড়ে গেলে সেটি কি আর মোবাইল বলা যায়? গার্টনারের বিশ্লেষক কেন ডুলানি অন্তত বড়ো আকারের স্মার্টফোনগুলোকে মোবাইল মানতে নারাজ। কারণ বাজারে তো প্রায় সমান আকারের ট্যাবলেট রয়েছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, ট্যাবলেট বা স্মার্টফোন নির্ধারণ করতে যুক্তিসঙ্গত পথে যেতে হবে। আর তা হচ্ছে পকেটের মাপ। সবচেয়ে যে প্রশ্নটা প্রধান হয়ে দাঁড়াচ্ছে তা হলো, কোন আকারের ডিভাইস পকেটে রাখা যাবে? আর  কোনটাই বা সর্বন্মি সীমা? স্মার্টফোন নাকি ট্যাবলেট এ বিতর্ক নিয়েই এবারের মেইনবোর্ড।

যারা প্রযুক্তির খবর রাখেন তারা একটা বিষয় নিশ্চয়ই খেয়াল করেছেন, বর্তমান প্রযুক্তি বিশ্বে যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম হিসেবে স্মার্টফোন এবং ট্যাবলেট একটা গুরুত্বপূর্ণ স্থান করে নিয়েছে। আর সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ট্যাবলেট স্ক্রিনের আকার ছোটো হয়ে আসছে। একই সঙ্গে বড়ো হচ্ছে স্মার্টফোনের স্ক্রিনের মাপ। প্রযুক্তিবিশ্লেষকরা বলছেন, ‘মানুষ এখন একটা ডিভাইসের মধ্যেই ট্যাবলেট এবং স্মার্টফোন উভয় সুবিধা চাইছে। আর এ বিষয়টিই এখন ডিভাইস নির্মাতাদের মস্তিষ্কে গেঁথে গেছে। তারাও ভোক্তাদের পছন্দানুয়ায়ী মাপের ডিভাইস তৈরির দিকে ঝুঁকছেন।’
বিশ্লেষকরা বলছেন, ২০১২ সাল হবে ট্যাবলেট এবং স্মার্টফোনের বছর। কারণ এ বছরটির দিকেই চেয়ে রয়েছে খ্যাতনামা প্রযুক্তিপ্রতিষ্ঠানগুলো। অ্যাপল, গুগল, স্যামসাং, ফেসবুক, নকিয়া, এসার, অ্যামাজন, লেনোভো, আসুস থেকে শুরু করে অনেক প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানই ট্যাবলেট এবং স্মার্টফোন বাজারে আনার ঘোষণা দিয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠান বাজার ধরতে বিভিন্ন মাপের ডিভাইস তৈরির ঘোষণা দিয়েছে। দেখা গেছে, প্রায় ক্ষেত্রেই বড় আকারের স্মার্টফোন এবং ট্যাবলেটের ক্ষেত্রে ছোটো আকারের ট্যাবলেটের দিকে ঝুঁকেছে প্রতিষ্ঠানগুলো।


অ্যাপলের আইওএস, মাইক্রোসফট উইন্ডোজ এবং গুগলের অ্যান্ড্রয়েড অপারেটিং সিস্টেমনির্ভর স্মার্টফোন বাজারে রয়েছে। ২০১২ সালে উইন্ডোজ ৮ অপারেটিং সিস্টেম বাজারে এলে উইন্ডোজনির্ভর স্মার্টফোন এবং ট্যাবলেট তৈরির ঘোষণা দিয়ে রেখেছে  অনেক প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান। এ ছাড়াও অ্যান্ড্রয়েডও বাজার দখল করেছে শতকরা ৫০ ভাগ। আইফোনের বাজারও রমরমা। এই তিন জায়ান্টের তৈরি অপারেটিং সিস্টেমেই স্মার্টফোন নাকি ট্যাবলেট বাজারে থাকবে নাকি এ দুইয়ের মাঝামঝি কোনো ডিভাইস বাজার দখল করবে তা নিয়ে বিশ্লেষকরা রীতিমত গলদঘর্ম।

স্মার্টফোন এবং ট্যাবলেট বাজারে সবচেয়ে যুগান্তকারী পরিবর্তন ঘটিয়েছে অ্যাপল। আইফোনের জনপ্রিয়তা স্মার্টফোন বাজারে অ্যাপলকে নতুন সংস্করণ আনতে উদ্বুদ্ধ করে। এ ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি বাজারে এসেছে আইফোন ৪ এস। নতুন সফটওয়্যার এবং বিভিন্ন ফিচারের আপডেটসহ এ স্মার্টফোনটি বাজারে সাড়া জাগিয়েছে। তবে, আইফোন ৪ এস-এর চেয়েও আলোচনা বেশি হয়েছে অ্যাপলের আইফোন ৫ নিয়ে। বছরজুড়েই বিভিন্ন প্রযুক্তি সাইটে আইফোন ৫ ঘিরে ছিলো গুজবের ছড়াছড়ি। অ্যাপল কর্তৃপক্ষ মুখ না খুললেও বিভিন্ন সূত্রের বরাত দিয়ে প্রযুক্তিবিশ্লেষকরা বলছেন, আগামী বছরই এ স্মার্টফোনটি বাজারে আসবে। আর এ ফোনটির সবচেয়ে পরিবর্তন চোখে পড়বে তা এর স্ক্রিনের মাপে। বর্তমান মাপের চেয়ে আরো বড়ো হবে আইফোনের পরবর্তী সংস্করণ। অ্যাপলের আইপ্যাডকে ট্যাবলেট দুনিয়ার স্ট্যান্ডার্ড ধরা হয়। আইপ্যাডের জনপ্রিয়তা ট্যাবলেট বাজার উন্মুক্ত করেছে। ১০.১ ইঞ্চি মাপের নীচে কোনো ট্যাবলেট কম্পিউটার ভালোমানের প্রযুক্তি হবে না এমন ভবিষ্যৎদ্বাণী করেছিলেন অ্যাপলের প্রয়াত সিইও স্টিভ জবস। তিনি না চাইলেও অন্য প্রতিষ্ঠানগুলো ট্যাবলেটের মাপে পরিবর্তন আনছে দ্রুত। এক্ষেত্রে সবচেয়ে এগিয়েছে স্যামসাং। স্যামসাং গ্যালাক্সি সিরিজের ডিভাইসগুলো ক্রেতাদের পছন্দানুয়ায়ী করতে মাপের ক্ষেত্রে বিভিন্ন পরিবর্তন এনেছে স্যামসাং। ট্যাবলেট এবং স্মার্টফোনের পার্থক্য তারা প্রায় ঘুচিয়ে ফেলেছে। ২০১২ সাল নাগাদ স্যামসাং এ মাপে আরো পরিবর্তন আনতে পারে। ফিনিশ মোবাইল জায়ান্ট নকিয়াও পিছিয়ে নেই। নকিয়া কর্তৃপক্ষ উইন্ডোজনির্ভর স্মার্টফোনের পাশাপাশি ট্যাবলেট বাজারে আনার কথাও জানিয়েছে। নকিয়ার এসব ডিভাইসগুলোর মাপেও থাকছে বৈচিত্র্য।
বর্তমানে সাড়া ফেলেছে অ্যামাজনের তৈরি কিন্ডল ফায়ার নামের ৭ ইঞ্চি মাপের একটি ট্যাবলেট। এ ছাড়াও নতুন সংস্করণের ৮.৯ ইঞ্চি মাপের একটি ট্যাবলেট বাজারে আনার খবরও রয়েছে। বাজারে এখন ১০.১ এবং ৯.৭ ইঞ্চি মাপের ট্যাবলেটের আধিক্য থাকায় নতুন মাপের ট্যাবলেট তৈরির দিকে ঝুঁকছে ট্যাবলেট নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলো।

বার্লিনে অনুষ্ঠিত আইএফএ কনজিউমার ইলেকট্রনিক শো‘র পর থেকেই ডিভাইসের মাপে এ পার্থক্য শুরু হয়েছে। স্যামসাং গ্যালাক্সি এস টু, স্যামসাং গ্যালাক্সি নোট, এইচটিসি উইন্ডোজ ফোন ৭ বা টাইটান-এ স্ক্রিনের মাপ ৪.৫ ইঞ্চি এবং ৫.৫ ইঞ্চি। এছাড়াও সনি তাদের ‘ট্যাবলেট পি’তে ৫.৫ ইঞ্চি মাপের দুটি স্ক্রিন জুড়ে আরো বৈচিত্র্য যোগ করেছে।
পরিবর্তনের শুরু:
২০১১ সালের শুরুতেই সিইএস মেলায় নতুন আকারের স্মার্টফোনের ঘোষণা এসেছে। এর মধ্যে রয়েছে ৪.৫ ইঞ্চি মাপের স্যামসাং ইনফিউজ। এ ছাড়াও রয়েছে ৪.৩ ইঞ্চি মাপের  মটোরোলা ফোটন ৪জি, মটোরোলা ড্রয়েড বায়োনিক। এ ছাড়াও ৫ ইঞ্চি মাপের ডেল স্ট্রেক ফোনটিও চোখে পড়ার মতো।

বিশ্লেষক প্রতিষ্ঠান এনপিডি গ্রুপের একটি তথ্যে দেখা গেছে, ৪ ইঞ্চি বা তার চেয়েও বড় মাপের স্মার্টফোন বিক্রি বেড়ে গেছে। ২০১০ সালে ৪ ইঞ্চি বা তার চেয়ে বড়ো মাপের স্মার্টফোন বিক্রি হয়েছে ২৪ শতাংশ। এ ছাড়াও ৩.৪ ইঞ্চি বা তার চেয়ে ছোটো মাপের স্ক্রিনের মোবাইল বিক্রি কমে গেছে। এটি ৬৩ ভাগ থেকে কমে দাঁড়িয়েছে ৩৬ ভাগে।

ইন্ড্রাস্ট্রি অ্যানালিস্ট এনপিডি’র এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর রস রুবিন জানিয়েছেন, বড়ো স্ক্রিনের মোবাইল বিক্রি বেড়ে যাওয়ার কারণ হচ্ছে ওয়েব কন্টেন্ট এবং ভিডিও দেখা বেড়ে যাওয়া। বড়ো পর্দায় মিডিয়া ভালো দেখা যায় এবং অনস্ক্রিন কিবোর্ড ব্যবহার করা যায়।
বিশ্লেষকদের মত:
স্ক্রিনের মাপ বেড়ে গেলে সেটি কি আর মোবাইল বলা যায়? গার্টনারের বিশ্লেষক কেন ডুলানি অন্তত বড়ো আকারের স্মার্টফোনগুলোকে মোবাইল মানতে নারাজ। কারণ বাজারে তো প্রায় সমান আকারের ট্যাবলেট রয়েছেই।

কেন ডুলানি‘র মতে, ‘স্মার্টফোনের সব্বোর্চ মাপ হতে পারে ৪.২ ইঞ্চি আর ট্যাবলেটের সর্বনিন্ম মাপও এটাই। তাই ৪.৫ ইঞ্চি মাপের ডিভাইসগুলো আমার মতে ছোটো ট্যাবলেট।’

বিশ্লেষকরা বলছেন, ট্যাবলেট বা স্মার্টফোন নির্ধারণ করতে যুক্তিসঙ্গত পথে যেতে হবে। আর তা হচ্ছে পকেটের মাপ। সবচেয়ে যে প্রশ্নটা প্রধান হয়ে দাঁড়াচ্ছে তা হলো, কোন আকারের ডিভাইস পকেটে রাখা যাবে? আর কোনটাই বা সর্বন্মি সীমা?

রস রুবিন এ প্রশ্নের উত্তরে বলেছেন, ‘স্যামসাং গ্যালাক্সি নোট ডিভাইসটির স্ক্রিনের মাপ ৫.৩ ইঞ্চি। এ ডিভাইসটির ক্ষেত্রে স্যামসাং-এর দাবী এটাই পকেটে ঠিকমতো রাখা যাবে এবং এটাই সব্বোর্চ সীমা। আর আমার মনে হয় এটা একটা ট্যাবলেট, এটা কিছুতেই মোবাইল নয়।’
বাজারে এখন স্মার্টফোন এবং ট্যাবলেটের ছড়াছড়ি। বেড়ে গেছে প্রতিযোগিতা। প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে এবং গ্রাহকের মন কাড়তে আকারে পরিবর্তন জরুরী। আর তাই বড়ো আকারের স্মার্টফোন তৈরির দিকেই এখন ঝুঁকছে নির্মাতারা যাতে ট্যাবলেট এবং স্মার্টফোনের পার্থক্য ঘুঁচে যায়।

সিএসএস ইনসাইট-এর বিশেষজ্ঞ জিওফ ব্ল্যাবার জানিয়েছেন, বর্তমানে বাজারে  কোনো স্মার্টফোন কিনতে গেলে ক্রেতাদের কাছে ট্যাবলেট এবং স্মার্টফোনের মধ্যে পার্থক্য করা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। বাজারে স্মার্টফোনের আকারের পরিবর্তন ডিভাইসগুলোর মধ্যে পার্থক্য গড়ে দিচ্ছে। মোবাইলের স্ক্রিন কেবল বড়ো হচ্ছে তাই নয় বরং আরো শার্প হচ্ছে। সুপার অ্যামোলিড প্রযুক্তি বা এইচডি প্রযুক্তি যোগ হচ্ছে। অচিরেই মোবাইলের ৫ ইঞ্চি পর্দায় ১২৮০ দ্ধ ৭২০ পিক্সেলের রেজুলিউশন পাওয়া যাচ্ছে।
স্মার্টফোন নাকি ট্যাবলেট?
পিউ ইন্টারনেট নামের একটি জরিপ প্রতিষ্ঠানের ফল বলছে, ৭২ শতাংশ স্মার্টফোন ব্যবহারকারী একঘেঁয়েমিতে ভুগলে বিনোদন হিসেবে মোবাইল ব্যবহার করে। ৬৪ শতাংশ মোবাইলে গেম খেলে, ৫৪ শতাংশ মোবাইলে ভিডিও দেখে। আর স্মার্টফোনের আকার বড়ো হবার কারণেই মোবাইল নির্ভরতা বেড়েছে। পিউ এর ফল বলছে, শতকরা শতভাগই মোবাইল ব্যবহার করে মেসেজ পাঠান এবং ৭৪ শতাংশ মেইল পাঠাতেও মোবাইল ব্যবহার করেন। কিন্তু বড়ো আকারের স্মার্টফোনে সমস্যা দেখা দেয় কল আদান প্রদানের ক্ষেত্রে। আকার বড়ো হবার কারণে কথা বলতে বা শুনতে সমস্যা হয়। ডিসপ্লে বড়ো মানের ব্যাটারির সমস্যা। বেশি চার্জ লাগে। এ ছাড়াও বহন করতে জায়গা লাগে বেশি। প্রয়োজন পড়ে ব্লুটুথ ডিভাইসেরও।

তবে, ডিভাইসগুলোর পরিচিতি বিশালাকার স্মার্টফোন নাকি পকেটে মানানসই ট্যাবলেট হিসেবে বিবেচনা করা হবে সেটির ভার ব্যবহারকারীর ওপর ছেড়ে দিচ্ছে নির্মাতারা। আগামী প্রজন্মের বিভিন্ন প্রযুক্তি, অপারেটিং সিস্টেম এবং হার্ডওয়্যার দিয়ে তৈরি এসব ডিভাইসগুলোর দামও চলে আসছে হাতের নাগালেই। ১০.১ ইঞ্চি মাপের  ট্যাবলেট নাকি ৩.৪ ইঞ্চি মাপের মোবাইল নাকি ৫ ইঞ্চির কাছাকাছি উভয় ডিভাইস হিসেবেই কাজ করবে এমন স্মার্টফোন? বেছে নিতে হবে ক্রেতাকেই। আর ২০১২ সালে এমন ডিভাইসই বাজারে আসবে বেশি।

Blogger templates

.
Recommended Post Slide Out For Blogger