হারিয়ে যাওয়া টাইটানিক, খুঁজে পাওয়া টাইটানিক

|
বলো তো, পৃথিবীর সবচেয়ে বিখ্যাত জাহাজ কোনটা? কেন, টাইটানিক। যে জাহাজটিকে বলা হচ্ছিল কখনোই ডুববে না, সেই জাহাজটিই কিনা ডুবে গিয়েছিল প্রথমবারের মতো সাগরে ভেসেই। টাইটানিক কবে ডুবে গিয়েছিল, মনে আছে? ১৯১২ সালের ১৫ এপ্রিল। মানে, এই বছর ১৫ এপ্রিল টাইটানিক ডুবে যাওয়ারও ১০০ বছর হয়ে যাচ্ছে। তবে এ বছর টাইটানিক প্রেমীদের জন্য একটা সুখবরও আছে- এ বছরই টাইটানিকের ডুবে যাওয়া ধ্বংসাবশেষকে ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট হিসেবে ঘোষণা করেছে। মানে, এখন আর চাইলেই কেউ টাইটানিক দেখতে গিয়ে টাইটানিকের ক্ষতি করতে পারবে না। আর টাইটানিকের মালপত্র সরানো তো যাবেই না।
 

টাইটানিক হারিয়ে যাওয়ার গল্প
টাইটানিকের গল্প তো তোমরা জানোই, কী বিশালই না ছিল এই টাইটানিক। প্রায় তিন-তিনটা ফুটবল মাঠের সমান। শুধু কী তাই? সেই কবেকার এই জাহাজটিতে ছিল একটা বিশাল সুইমিং পুল, যেখানে গরম পানিরও বন্দোবস্ত ছিল। ছিল আরাম-আয়েশ আর বিলাস-এর সব ব্যবস্থাই। সব মিলিয়ে যাকে বলে এক ভাসমান সুরম্য প্রাসাদ। আর তাই দেখ না, টাইটানিক সিনেমায় যখন জাহাজটিকে দেখ, মনেই হয় না ওটা সেই ১৯১২ সালের জাহাজ। বাজারে তো এমন কথাও রটে গেল, স্বয়ং ঈশ্বরও এই জাহাজকে ডোবাতে পারবেন না, এমনই মজবুত এই টাইটানিক!
এমন একটা জাহাজ, আর তাতে রাজ্যের যতো বড়লোকরা চড়বে না, তাই কী হয়? রীতিমতো হুড়োহুড়ি করে বিক্রি হল টাইটানিকের প্রথম যাত্রার টিকিট। প্রথম যাত্রার রুট ছিল ইংল্যান্ডের সাউদাম্পটন শহর থেকে আমেরিকার নিউ ইয়র্ক শহর। ১৯১২ সালের ১০ এপ্রিল সাউদাম্পটন থেকে রওয়ানা হল তখনকার সবচাইতে বড় আর সবচাইতে বিলাসী জাহাজ। যারা জাহাজটির প্রথম ভ্রমণে যাত্রী হতে পারলো, তাদের তো খুশি আর ধরে না। সারাদিনই যেন জাহাজে পার্টি হচ্ছে, এমন অবস্থা। এমনি করেই পার হয়ে গেল কয়েকটি দিন।

১৪ এপ্রিল, রাত প্রায় ১২টা। আটলান্টিক সাগরের বুকে ভেসে যাচ্ছে টাইটানিক। তখন টাইটানিক আমেরিকার কাছাকাছি চলে এসেছে, গ্র্যান্ড ব্যাংকস অফ নিউফাউন্ডল্যান্ডে। আবহাওয়া খুবই খারাপ; ভীষণ ঠাণ্ডা আর জমাট বাঁধা কুয়াশা। নিউফাউন্ডল্যান্ড পার হয়ে যাওয়া জাহাজগুলো এর মধ্যেই এখানকার ভাসমান বরফ, মানে আইসবার্গ সম্পর্কে সতর্ক করে দিয়েছে টাইটানিককে। কিন্তু টাইটানিকের ক্যাপ্টেন এডওয়ার্ড জন স্মিথ আর অন্যান্য ক্রুরা তো তাদের এসব কথাকে পাত্তাই দেননি। তাদের ভাবখানা এমন- কোথাকার কোন বরফ নাকি টাইটানিককে ডোবাবে! টাইটানিক আগের মতোই ২১ নটিক্যাল মাইলে (২৪ মাইল) চলতে লাগলো। ২১ নটিক্যাল মাইলকে আবার কম ভেবো না; তখন টাইটানিক ছিল অন্যতম দ্রুতগতির জাহাজ, আর তার সর্বোচ্চ গতিই ছিল ২৪ নটিক্যাল মাইল।
ওদিকে জাহাজের সামনে কোনো বাধা আছে কিনা দেখার জন্য জাহাজের ডেকে একটা উঁচু টাওয়ারের মতো থাকে। সেখানে পালা করে কয়েকজন চোখ রাখে। তখন সেখানে ছিলেন ফ্রেডরিক ফ্লিট। হঠাৎ তিনি দেখলেন, কুয়াশার আড়াল থেকে বের হয়ে এল এক বিশাল আইসবার্গ। আইসবার্গ হল সাগরের বুকে ভাসতে থাকা বিশাল বিশাল সব বরফখণ্ড। এগুলোর সবচেয়ে ভয়ংকর ব্যাপার হলো, এগুলোর মাত্রই আট ভাগের এক ভাগ পানির উপরে থাকে। মানে, এর বড়ো অংশটাই দেখা যায় না। আর বরফের রংও তো কুয়াশার মতোই সাদা, তাই ফ্লিটও প্রথমে ওটাকে আলাদা করে চিনতে পারেনি। যখন দেখতে পেল, ততোক্ষণে আইসবার্গটি অনেক কাছে চলে এসেছে।
ফ্লিট তো আইসবার্গ দেখেই খবর দিতে ছুটলো। ফার্স্ট অফিসার উইলিয়াম মারডক শুনেই জাহাজ পিছনের দিকে চালাতে বললেন। আর মুখ ঘুরিয়ে দিতে বললেন অন্যদিকে। যাতে কোনভাবেই বিশাল ওই আইসবার্গটির সঙ্গে টাইটানিকের সংঘর্ষ না হয়। কিন্তু লাভ হলো না। টাইটানিকের স্টারবোর্ডে আইসবার্গ ধাক্কা খেল। আর তাতে টাইটানিকের পানির নিচে থাকা অংশে অনেকগুলো গর্ত হলো। পানি ঢুকতে লাগলো দৈত্যাকার জাহাজের খোলের ভেতর।
কিছুক্ষণের মধ্যেই এটা পরিস্কার হয়ে গেল, লোকজন যে জাহাজকে ভাবছিল কখনোই ডুববে না, সেই জাহাজই ডুবে যাচ্ছে তার প্রথম যাত্রাতেই। এবার যাত্রীদের লাইফবোটে তুলে পার করে দেওয়ার পালা। কিন্তু কেউ তো এ নিয়ে ভাবেই নি। লাইফবোট যা আছে, তা দিয়ে বড়োজোর মোট যাত্রীদের তিন ভাগের এক ভাগকে বাঁচানো যাবে। তখন এক বিশেষ নীতি অনুসরণ করা হলো- শিশু এবং নারীদেরকে প্রথমে লাইফবোটে করে পাঠানো হতে লাগলো।
এমনি করে কোনো রকমে বিশাল টাইটানিকের মোটে ৩২ শতাংশ যাত্রীদের বাঁচানো গেল। মাত্র ঘণ্টা চারেকের মধ্যে ডুবে গেল সুবিশাল টাইটানিক, ১৫ এপ্রিল রাত ২টায়। টাইটানিকের সঙ্গে আটলান্টিকে ডুবে গেল প্রায় ১৫ শ' মানুষ। মানুষের ইতিহাসেই এরকম বড়ো দুর্ঘটনা আর ঘটেছে কিনা সন্দেহ।
টাইটানিক তো ডুবে গেল আটলান্টিকে, কিন্তু আটলান্টিকের বুকে তার কী হলো? কেউ কেউ বললো, টুকরো টুকরো হয়ে গেছে। কেউ বললো, টুকরো টুকরো হবে কেন, দু’ভাগ হয়ে পড়ে আছে। কিন্তু যতো গভীরে আছে, সেখান থেকে টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষ উদ্ধার করা সম্ভব নয়। উদ্ধার কেন, চিহ্নিত করাই তো অসম্ভব। এমনি করেই আড়ালে চলে গেল হোয়াইট স্টার লাইন কোম্পানির জাহাজটি।

টাইটানিক খুঁজে পাওয়ার গল্প
কিন্তু টাইটানিককে বেশিদিন চোখের আড়ালে থাকতে দিলেন না রবার্ট বালার্ড। ফরাসি এই বিজ্ঞানীর ছোটবেলা থেকেই ইচ্ছে ছিল টাইটানিককে খুঁজে বের করবেন। বড়ো হয়ে তিনি সেই কাজেই নামলেন। ১৯৮৫ সালে তিনি জাহাজ নিয়ে ঘাঁটি গাড়লেন গ্রেট ব্যাংকস অফ নিউফাউন্ডল্যান্ডে, যেখানে ডুবে গিয়েছিল টাইটানিক। সঙ্গে নিলেন নানা আধুনিক যন্ত্রপাতি। আর্গো নামের একটি আন্ডারওয়াটার ক্র্যাফট পাঠিয়ে দিলেন সাগরতলে। আর্গো সাগরতলের দৃশ্য ভিডিও করে নিয়ে আসতো।
কিন্তু কিছুতেই পাওয়া গেল না টাইটানিককে। হতাশ হয়ে পড়লেন বালার্ড। এদিকে টানা পরিশ্রমে তার শরীরও দুর্বল হয়ে পড়েছে। একটু বিশ্রাম দরকার তার। কিন্তু কীসের বিশ্রাম! যেই একটু ঘুমুতে গেলেন, অমনি তার ডাক পড়লো। আর্গোর ভিডিওতে মেটাল অবজেক্ট পাওয়া গেছে, যেগুলো শুধু কোনো জাহাজ থেকেই ভেসে আসা সম্ভব। উত্তেজনায় যা ঘুম ছিল, সব চলে গেল বালার্ডের। একটু খোঁজাখুজির পর জাহাজটিকে পাওয়া গেল। হ্যাঁ, এটাই টাইটানিকের দৈত্যাকৃতির ধ্বংসাবশেষ।
এবার আর্গোকে দিয়ে নানা দিক দিয়ে টাইটানিকের ছবি তুললেন বালার্ড। দেখলেন টাইটানিকের যাত্রীদের নানা স্মৃতিচিহ্ন- বিছানা, সুটকেস, কাপ- প্লেট, আর অসংখ্য জুতো। যেন সাগরতলের এক জাদুঘরের ভিডিও দেখছেন তিনি।
কিন্তু সময় ফুরিয়ে এল। তাকেও ফিরে যেতে হলো। তখনই ঠিক করলেন, আবার আসবেন টাইটানিকের কাছে। পরের বছরই আবার এলেন বালার্ড। এবার আরো প্রস্তুত হয়ে।
ছোট্ট একটা সাবমেরিনে চড়ে এলেন বালার্ড। সাথে নিয়ে এলেন সাগরতলে ঘোরাঘুরি করতে পারে, এমন একটি রোবটও; নাম তার জেজে। বালার্ড অবশ্য ওকে বলতেন- সুইমিং আইবল। জেজের সাহায্যে তিনি দেখলেন পুরো টাইটানিককে; এর বিশাল সিঁড়িটা এখন কেমন আছে, কেমন আছে ওর জিম, চেয়ার, ঘর, সব।
বালার্ডের টাইটানিক আবিষ্কার তো হলো, কিন্তু তিনি জানতে চাইলেন, কীভাবে ডুবে গেল টাইটানিক। আর তা বোঝার জন্য আবারো তিনি গেলেন টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষে, ২০০৪ সালের জুন মাসে। এবার গিয়ে কিন্তু তার মনই খারাপ হয়ে গেল।
বালার্ড টাইটানিক আবিষ্কার করার পর থেকেই মানুষ সাবমেরিনে করে সেখানে ঘুরতে যায়। এই সাবমেরিনগুলো টাইটানিকের যে সব জায়গায় ল্যান্ড করে, সেসব জায়গাতে দাগ তো পড়েছেই, অনেক জায়গায় গর্তও হয়ে গেছে। আর মানুষ জাহাজ থেকে প্রায় ৬ হাজার জিনিস নিয়ে গেছে। এমনকি অনেকে নিয়ে গেছে জাহাজের টুকরোও!
তখন থেকেই টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষ সংরক্ষণের দাবি ওঠে। আর এ বছর তো ইউনেস্কো টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষকে আন্ডারওয়াটার ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট হিসেবেই ঘোষণা করে দিয়েছে।
১৪ এপ্রিল পহেলা বৈশাখ, আমাদের ভীষণ আনন্দের দিন। সেদিন তো খুব আনন্দ করবে। কিন্তু পরের দিন মনে করে টাইটানিকের সাথে ডুবে যাওয়া ১৫শ’ মানুষের কথাও স্মরণ করো। ঠিক ঠিক করে বললে ১৫১৪ জন।

Blogger templates

.
Recommended Post Slide Out For Blogger