মানব শরীরকে সংরক্ষণ করে রাখার পদ্ধতি - প্লাস্টিনেশন

মানব শরীরকে টিকিয়ে রাখার জন্য শত শত বছর ধরে মানুষ নানাভাবে
চেষ্টা করে আসছে৷ সেই প্রাচীন মিশরের মমি থেকে শুরু করে আধুনিক জগতের
প্লাস্টিনেশন৷ শুরুতে লক্ষ্যটা ছিলো ধর্মীয় বিশ্বাস থেকে৷ কিন্তু আধুনিক
বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রার সঙ্গে সঙ্গে এই দেহ সংরক্ষণের উদ্দেশ্য হয়েছে
শরীরকে চেনা ও জানা৷ মানব শরীরের মধ্যে লুকিয়ে থাকা অপার রহস্যকে খুঁজে
বের করা৷
১৯৭৭ সালে জার্মান বিজ্ঞানী গ্যুন্টার ফন হাগেন্স এই প্লাস্টিনেশন
পদ্ধতি আবিষ্কার করেন৷ প্লাস্টিনেশন শব্দটি এসেছে গ্রিক শব্দ ‘প্লাসিন'
থেকে যার অর্থ আকৃতিতে রূপ দেওয়া৷ প্লাস্টিনেশনের মাধ্যমে কেবল জৈবিক
শরীরের অঙ্গ ও কোষ নয়, গোটা শরীরকেও সংরক্ষণ করা হয়৷
মানুষ মারা যাওয়ার পর থেকেই তার শরীর দ্রুত পচতে শুরু করে যাকে বলা হয় ‘ডিকম্পোজিশন'৷ প্রথমে শরীরে থাকা এনজাইম কোষগুলো অবমুক্ত হতে শুরু করে
এবং এক পর্যায়ে গোটা শরীরে থাকা ব্যাকটেরিয়া এবং মাইক্রোঅর্গানিজমগুলো
পচতে শুরু করে৷ শরীরে থাকা পানি এবং চর্বি সরিয়ে তার জায়গায় পলিমার ঢুকিয়ে
প্লাস্টিনেশন এই পচে যাওয়াকে রোধ করে৷ প্লাস্টিনেশন শরীরের
ব্যাকটেরিয়াগুলোকে টিকে থাকতে দেয় না, ফলে শরীরও আর পচতে পারে না৷ তবে
শরীরের তরল পদার্থগুলো সরাসরি পলিমারের সংস্পর্শে কাজ করতে পারে না৷ তাই
গ্যুন্টার ফন হাগেন্স একটি বিকল্প ব্যবস্থা উদ্ভাবন করেছেন৷ প্রথমে
শরীরের মধ্যে অ্যাসেটোন নামে দ্রাবক ঢুকানো হয় এরপর তার জায়গায় পলিমার
ব্যবহার করা হয়৷
প্লাস্টিনেশনের মাধ্যমে শরীরকে দুইভাবে সংরক্ষণ করা হয়৷ একটা হলো
কাগজের মত পাতলা করে মৃত শরীরটিকে কেটে কেটে রাখা৷ নয়তো পুরো আস্ত
শরীরটাকেই বিভিন্ন ভঙ্গিতে রেখে দেওয়া৷
প্লাস্টিনেশনের ধাপগুলো এবার আরও সহজভাবে বলি৷ প্রথম পর্যায়ে মৃতদেহটির
ভেতরে ফর্মালিন ঢোকানো হয়৷ ধমনির মাধ্যমে এই ফর্মালিন গোটা দেহে ছড়িয়ে
পড়ে এবং এই ফর্মালিন ব্যকটেরিয়াগুলোকে মেরে ফেলে৷ ফলে শরীরের কোষগুলোর
‘ডিকম্পোজিশন' বা দ্রুত পচন প্রক্রিয়া থেমে যায়৷ এরপর গোটা শরীরটাকে
অ্যাসেটোন নামক একটি দ্রাবকের চেম্বারে মাইনাস ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস
তাপমাত্রায় চুবিয়ে রাখা হয়৷ তবে তার আগে দেহ থেকে পানি এবং অতিরিক্ত চর্বি
সরিয়ে ফেলা হয়৷ উল্লেখ্য, দেহকোষের শতকরা ৭০ ভাগই কিন্তু পানি৷ পরবর্তী
পর্যায়ে অ্যাসেটোনের জায়গায় পলিমার সলিউশন ব্যবহার করা হয়৷ এজন্য
মৃতদেহটিকে একটি ভ্যাকুয়াম চেম্বারের মধ্যে রাখা হয় এবং তার ভেতরে বাতাসের
চাপ আস্তে আস্তে কমানো হয়৷ এক পর্যায়ে চেম্বারে থাকা অ্যাসেটোন ফুটতে
শুরু করে৷ এভাবে কোষে জমে থাকা অ্যাসেটোনগুলো বের হয়ে যেতে শুরু করে৷
চেম্বারের অন্য একটি পাইপ দিয়ে ঢোকানো হয় পলিমার৷ যেমন এই ক্ষেত্রে
ব্যবহার করা হয় সিলিকন রাবার৷ এই সিলিকন রাবার কোষগুলোর ভেতরে প্রবিষ্ট হয়
এবং দেহের সবকোষে এই পলিমার বা সিলিকন রাবার পুরোপুরি প্রবিষ্ট না হওয়া
পর্যন্ত এই প্রক্রিয়া চলতে থাকে৷
এভাবে কয়েক সপ্তাহ পার হয়৷ সিলিকন রাবারের কারণে গোটা চেম্বারই একটি
শক্ত টুকরোয় পরিণত হয় যার ভেতরে শুয়ে আছে মৃত মানুষের শরীরটি৷ তারপর সেই
জমাট বাধা শক্ত টুকরোটি বিশেষভাবে কাটা হয়৷ অত্যন্ত পাতলা মাত্র কয়েক
মিলিমিটার চওড়া করে কাটা এসব ফালিগুলোতে একটি মানুষের শরীরের প্রতিটি অংশ
স্পষ্টভাবে ফুটে ওঠে৷ একে বলা হয় শিট প্লাস্টিনেশন৷
তবে মৃতদেহটিকে পলিমারের মধ্যে জমতে না দিয়ে বের করেও আনা যায়৷ এই
ক্ষেত্রে দেহটিকে যে কোন ভঙ্গিতে বসানো কিংবা দাঁড় করানো যায়৷ তবে এইজন্য
বিশেষ পলিমার ব্যবহার করতে হয় যেটা আলো, বাতাস এবং তাপের মধ্যে টিকে
থাকতে পারে৷ এরপর পুরো দেহটিকে একটি এয়ার টাইট চেম্বারে রাখা হয় এবং তাতে
গ্যাস এবং তাপ ঢোকানো হয়৷ এর ফলে দেহটিকে যেই ভঙ্গিতে বসানো হয়েছে
সেভাবেই সেটি শক্ত হয়ে যায় এবং এভাবেই টিকে থাকে মাসের পর মাস৷ একে বলা
হয় ফিগার প্লাস্টিনেশন৷
প্লাস্টিনেশনের এই প্রক্রিয়া শেষ করতে সাধারণত এক বছর লেগে যায়৷
| 


