কনফুসিয়াসের গল্প

|
মানুষের মধ্যে সবচেয়ে যে ভালো মানুষ, তার কী কী গুণ থাকা দরকার, বলো তো? এর উত্তরে কনফুসিয়াস কী বলেছেন জানো? সবচেয়ে ভালো মানুষের থাকতে হবে দুটি গুণ- ‘জেন’ আর ‘ই’; ‘জেন’ মানে হলো অন্যের প্রতি ভালোবাসা। আর ‘ই’ মানে হলো সৎ আচরণ ও ন্যায়পরায়ণতা। যে মানুষটি অন্য সব মানুষকে ভালোবাসে, আর সব কাজে সৎ আর ন্যায়পরায়ণ থাকে, তাকেই তো সবচেয়ে ভালো মানুষ বলা যায়, তাই না?

আজ থেকে প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে জন্মেছিলেন কনফুসিয়াস। আর সেই সময়েই তিনি এমনি সব সুন্দর সুন্দর সব কথা বলেছিলেন। তার সে সব কথা মেনে চলত বলেই চীনারা হয়ে উঠেছিল এক সুসভ্য জাতি। অথচ সে কত্তো আগের কথা একবার ভাবো তো! তার সে সব সুন্দর সুন্দর সব কথা তার মৃত্যুর পরে ভক্তরা একত্রিত করে লিখে রাখতে শুরু করে। এভাবেই তার বইগুলো রচিত হয়। মোটমাট তার লেখা বইয়ের সংখ্যা ১৩টি (‘বসন্ত আর শরৎ বিষয়ক গ্রন্থ’ নামের আরো একটি ইতিহাস বিষয়ক গ্রন্থও তিনি লিখেছিলেন বলে ধারণা করা হয়)। আর সে সব মিলিয়ে দেখা গেল, মানুষের জীবনের প্রায় সবকিছু সম্পর্কেই কনফুসিয়াস দিকনির্দেশনা দিয়ে গেছেন। সে সব মিলিয়ে একটা জীবন দর্শনই হয়ে গেল, তার নাম দেয়া হল কনফুসিয়াসবাদ।



আচ্ছা, কনফুসিয়াস কেমন সুন্দর সুন্দর কথা বলেছিলেন, আর তাই শুনে চীনারা কেমন সভ্য হয়েছিল, সে সব গল্প আমরা পড়ে আরেকদিন শুনবো, আজকে বরং স্বয়ং কনফুসিয়াসেরই গল্প শুনি, কেমন?

অনুমান করা হয়, চীনের এই কিংবদন্তী মানুষটির জন্ম হয়েছিল খ্রিস্টের জন্মেরও ৫৫১ বছর আগে, চীনের সানদঙ প্রদেশে। এই প্রদেশেরই আরেক নাম লু। এই সানদঙ বা লু প্রদেশের রাজধানী ছিল কুফু নগরী। সেই নগরের ঝোউই নামের এক জায়গাতেই সম্ভবত তার জন্ম হয়েছিল।
তার এই জন্মস্থান সম্পর্কে এক মজার কথা প্রচলিত আছে। বলা হয়, তার জন্ম হয়েছিল সেখানে, যেখানে রয়েছে ‘হলুদ নদীর নয় বাঁক আর তাঈ পর্বতের এক চূড়ো’। এই ‘হলুদ নদী’ হল চীনের গণমানুষের প্রতীক। আর তাঈ পর্বতের শৃঙ্গ হল চীনের প্রাচীন সংস্কৃতির প্রতীক। আর এই তাঈ পর্বত আবার সানদঙ প্রদেশেই অবস্থিত।

 

 
তার আসল নাম কিন্তু কনফুসিয়াস নয়। আদতে কনফুসিয়াস কোন চীনা নামই নয়, ল্যাটিন নাম। ছোটবেলায় চৈনিক বা চীনা ভাষায় তার নাম রাখা হয় ‘কোঙ কিউ’। অনেকে আবার তাকে ‘কোঙ ঝোঙনি’ বলেও ডাকতো। পরে তিনি যখন পুরো চীনে ঘুরে ঘুরে তরুণদের মাঝে তার শিক্ষা প্রদান করতে শুরু করেন, তখন তার নাম হয়ে যায় ‘কোঙ ফু-জু’ বা কোঙ-এর মহাশিক্ষক। এই ‘কোঙ ফু-জু’ই পরে ল্যাটিনে রূপান্তরিত হয়ে কনফুসিয়াস হয়।
 

 
কনফুসিয়াসের পরিবার কিন্তু বেশ অভিজাত ছিল। তারা পারিবারিকভাবে ছিলেন সঙ প্রদেশের রাজকর্মচারি। কিন্তু তার দাদার যে হঠাৎ কী মনে হল, তিনি সেই চাকরি ছেড়ে চলে এলেন লু প্রদেশে। বসবাস করতে শুরু করলেন সাধারণ নাগরিকদের মতো করে। পরে তার বাবার আর্থিক অবস্থা তো একরকম খারাপই হয়ে গিয়েছিল। তার যখন মোটে ৩ বছর বয়স, তখন তার বাবা মারাই গেলেন। বুঝতেই পারছো, তাদের পরিবারের আর্থিক অবস্থা আরো খারাপ হয়ে গেল। কাজে কাজেই, খুব অল্প বয়সেই তাকে অর্থ উপার্জনের জন্য পথে বেরোতে হয়।

অর্থ উপার্জনের জন্য ছোটবেলায় নানা কাজ করেছিলেন কনফুসিয়াস। প্রথমে তিনি সরকারি উদ্যান আর শস্যের গুদাম দেখাশোনার কাজ নেন। সেটা ছেড়ে দিয়ে শুরু করেন হিসাবরক্ষকের কাজ। এরপরে তিনি ‘রু’ নামের একটি চাকরি গ্রহণ করেন। ‘রু’ হলো জন্ম, মৃত্যু, বিয়ে এসব উপলক্ষে যে সব সামাজিক অনুষ্ঠান পালিত হয়, সেগুলো পরিচালনা করার কাজ। তিনি যখন এই কাজ করছিলেন, তখনই তিনি ছয় কলায় পারদর্শী হয়ে ওঠেন- সদাচারণে, সঙ্গীতে, ধনুর্বিদ্যায় মানে তীর- ধনুক চালনায়, শকট চালনায়, লেখালেখিতে আর গণিতশাস্ত্রে।
কিন্তু এসব কাজই যদি করবেন, তাহলে আর কনফুসিয়াস হবেন কী করে? কয়েক বছর পরেই তিনি এই চাকরি ছেড়ে দিয়ে শিক্ষকতা শুরু করলেন। প্রথমে তিনি প্রায় ১৬ বছর ঘুরে বেড়ালেন নানা জায়গায়। শিখলেন মানুষের জীবন সম্পর্কে, জগৎ সম্পর্কে। এরপর তিনি তার এই অর্জিত জ্ঞান ছড়িয়ে দেয়ার উদ্যোগ নিলেন, বিশেষ করে তরুণদের মাঝে।

তখন চীনে শিক্ষাক্ষেত্রে বৈষম্য ছিল। অভিজাত লোকেদের সন্তানরা ছাড়া অন্যেরা শিক্ষিত হওয়ার সুযোগ পেত না। প্রথম থেকেই কনফুসিয়াস এই প্রথার বিরোধিতা করলেন। বললেন, শিক্ষার আবার বৈষম্য কী? মেধা অনুসারে সবারই শিক্ষার সমান অধিকার রয়েছে।
কিছুদিনের মধ্যেই কনফুসিয়াসের খ্যাতি চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ল। জি কাঙজি নামের এক জমিদার তাকে লু প্রদেশের রাজপ্রাসাদে নিয়ে গেলেন। সেখানে তার ভালো একটা চাকরিও হয়ে গেল। কিছুদিনের মধ্যেই তিনি পূর্তমন্ত্রী হয়ে গেলেন। কিছুদিনের জন্য অস্থায়ী প্রধানমন্ত্রীও ছিলেন। কিন্তু এই রাজকাজ নিয়ে পড়ে থাকলে কী আর কনফুসিয়াসের চলবে? তাই চার বছরের মাথায় তিনি এখান থেকেও পদত্যাগ করলেন। এবার শিষ্যদের নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন ভ্রমণে। গোটা চীনদেশই ভ্রমণ করবেন তিনি। গোটা চীনদেশে ঘুরে ঘুরে তার নিজস্ব চিন্তা-ভাবনা ধ্যান-ধারণা প্রচার করতে লাগলেন কনফুসিয়াস।

 

 
কনফুসিয়াসের শিষ্য বা ছাত্ররা সংখ্যায় ছিল প্রায় তিন হাজার। এদের মধ্যে প্রায় ৭২ জন তারই মতো ছয় কলায় পারদর্শী হন। এদের অনেকেই পরবর্তীতে লু প্রদেশের রাজদরবারে নানা পদে চাকরি পান। তারাই পরে চেষ্টা করেন তাকে নিজ দেশে ফিরিয়ে আনার। তাদেরই প্রচেষ্টায় শেষ জীবনে লুতে ফিরে আসেন কনফুসিয়াস। বাকি জীবন লুতে থেকে শিক্ষকতা করে আর বই লিখেই কাটিয়ে দেন তিনি।
 
 
লুতে ফিরে আসার ৫ বছর পর, খ্রিষ্টের জন্মের ৪৭৯ বছর আগে মৃত্যু হয় এই চৈনিক মহামানবের। কুফু নগরীর উত্তরে, সি নদীর তীরে সমাহিত করা হয় তাকে। ততোদিনে তিনি পুরো চীনেই জনপ্রিয়। সবাই তার সমাধি দেখতে আসতে শুরু করে। নির্মাণ করা হয় কনফুসিয়াস মন্দির। পরে গোটা চীনজুড়েই নির্মাণ করা হয় অসংখ্য কনফুসিয়াস মন্দির।

বেঁচে থাকতে থাকতেই তার চিন্তাধারা জনপ্রিয় হয়েছিল। কিন্তু তা শাসকদের আনুক‚ল্য পায় তার মৃত্যুর পরে। ফলে চীন ও তার আশপাশের অঞ্চলে তুমুল জনপ্রিয় হয়ে ওঠে কনফুসিয় চিন্তাধারা, কনফুসিয়াসের শিক্ষা। আর তার সেই চিন্তাধারা এখনো চীনাদেরকে প্রভাবিত করে চলেছে। শুধু চীনাদেরই বা বলছি কেনো, জাপান, কোরিয়া, ভিয়েতনামের অসংখ্য মানুষ এখনো কনফুসিয়াসের শিক্ষার অনুসারী।

কী তার সেই শিক্ষার মূলকথা? কেমন ছিল তার চিন্তাধারা? এসব তো আরো বড়ো গল্প, আরেকদিন না হয় বলবো। তবে সে সব তো বেশ কঠিন কথা, তোমাদেরকে বললে তোমরা ঠিক বুঝে উঠতে পারবে কিনা, তাই ভাবছি। তারচেয়ে বরং, তোমরা একটু বড় হয়, তারপর না হয় কনফুসিয়াসের শিক্ষা আর চিন্তাধারা সম্পর্কে নিজেরাই পড়ে নেবে, কেমন?

Blogger templates

.
Recommended Post Slide Out For Blogger