সে ১৯৪৫ সালের কথা। ততোদিনে প্রেমেন্দ্র মিত্রের বেশ নামডাক হয়ে গেছে, কবি হিসেবে, গল্পকার হিসেবেও। ওই একই বছরে পৃথিবীতে একটা বড় ঘটনা ঘটেছিলো। বলতে পারবে? হ্যাঁ, সেই বছরই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়। ১৪ আগস্ট মিত্রশক্তির কাছে জাপান আত্মসমর্পণ করে। মানে, এশিয়ায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ কার্যত শেষ। তখনো আমরা বৃটিশ সরকারের অধীন। মানে, আমরাও মিত্রশক্তির পক্ষেই ছিলাম। সব মিলিয়ে, ১৪ আগস্ট আমরা এক রকম যুদ্ধে জিতে গেলাম। পরদিন থেকেই বাংলায় আনন্দোৎসব শুরু হয়ে গেল। বর্ষা পেরিয়ে ততোদিনে চলে এসেছে শরৎকাল। কলকাতায় শরৎকাল মানেই পূজোর মাস, দূর্গা পূজার মাস। দেব সাহিত্য কুটির থেকে বের হলো বাংলা ১৩৫২ সালের পূজাবার্ষিকী আলপনা।
সেই পূজাবার্ষিকী সংখ্যার আলপনায় প্রেমেন্দ্র মিত্রের একটি গল্প প্রকাশিত হলো। ‘মশা’ নামের সেই গল্পটিই ঘনাদার প্রথম গল্প। তোমাদের বয়সীদের জন্য লিখলেও গল্পটি ছোট-বড় সবারই এত্তো ভালো লেগে গেলো! দেব সাহিত্য কুটির সাফ জানিয়ে দিলো, প্রতি বছর পূজাবার্ষিকী সংখ্যার জন্য ঘনাদার একটি গল্প তাদের চাই-ই চাই! আর ঘনাদার প্রতি প্রেমেন্দ্র মিত্রেরও বেশ ভালোবাসা ছিল। তিনিও বছর বছর ঘনাদা লিখে যেতে থাকলেন। এরপর প্রায় প্রতি বছরই নিয়ম করে প্রেমেন্দ্র মিত্র ঘনাদার গল্প লিখেছেন।
সেই পূজাবার্ষিকী সংখ্যার আলপনায় প্রেমেন্দ্র মিত্রের একটি গল্প প্রকাশিত হলো। ‘মশা’ নামের সেই গল্পটিই ঘনাদার প্রথম গল্প। তোমাদের বয়সীদের জন্য লিখলেও গল্পটি ছোট-বড় সবারই এত্তো ভালো লেগে গেলো! দেব সাহিত্য কুটির সাফ জানিয়ে দিলো, প্রতি বছর পূজাবার্ষিকী সংখ্যার জন্য ঘনাদার একটি গল্প তাদের চাই-ই চাই! আর ঘনাদার প্রতি প্রেমেন্দ্র মিত্রেরও বেশ ভালোবাসা ছিল। তিনিও বছর বছর ঘনাদা লিখে যেতে থাকলেন। এরপর প্রায় প্রতি বছরই নিয়ম করে প্রেমেন্দ্র মিত্র ঘনাদার গল্প লিখেছেন।
তোমরা যারা ঘনাদার গল্প পড়েছো, তাদের অনেকেই হয়তো ব্যাপারটা খেয়াল করেছো; ঘনাদাকে নিয়ে প্রেমেন্দ্র মিত্র যতো লিখেছেন, ততো একটু একটু করে ঘনাদার চরিত্রটিও আমাদের কাছে স্পষ্ট হয়েছে। এই যেমন ধরো, ঘনাদা কোথায় থাকেন? প্রথমদিকের গল্পে কিন্তু তার ঠিকানা দেয়া নেই, কলকাতার কোন এক মেসবাড়িতে তিনি থাকেন। পরে, ৬ নম্বর গল্প ‘টুপি’তে এসে আমরা জানতে পারলাম, তিনি থাকেন বাহাত্তর নম্বর বনমালি লস্কর লেনে।
আবার, ঘনাদার সঙ্গে এই বাহাত্তর নম্বর বনমালি লস্কর লেনে কে কে থাকে? গৌর, শিশির, শিবু আর কথক, মানে যে আমাদেরকে ঘনাদার গল্প বলছে। কিন্তু কথকের এই চরিত্রের নাম কী? অ-নে-ক পড়ে এসে জানা গেলো, এই কথক চরিত্রের নাম সুধীর। একটা মজার বিষয় কি জানো? সুধীর কিন্তু প্রেমেন্দ্র মিত্রেরই ডাকনাম!
আবার, ঘনাদার সঙ্গে এই বাহাত্তর নম্বর বনমালি লস্কর লেনে কে কে থাকে? গৌর, শিশির, শিবু আর কথক, মানে যে আমাদেরকে ঘনাদার গল্প বলছে। কিন্তু কথকের এই চরিত্রের নাম কী? অ-নে-ক পড়ে এসে জানা গেলো, এই কথক চরিত্রের নাম সুধীর। একটা মজার বিষয় কি জানো? সুধীর কিন্তু প্রেমেন্দ্র মিত্রেরই ডাকনাম!
ঘনাদা তো ছিলেন একটা আস্ত গুলবাজ, তাই না? বানিয়ে বানিয়ে কত্তো মজার মজার সব গল্প বলতেন! কিন্তু তিনি গল্পে যে সব কথা বলতেন, তার প্রতিটি তথ্যই সত্যি। তিনি যে সব বৈজ্ঞানিক বিষয় বা সূত্রের কথা বলতেন, সেগুলো একদম সত্যি। এমনকি নানা দেশের যে সব বর্ণনা দিতেন, সেগুলোও খাঁটি সত্য। প্রেমেন্দ্র মিত্র কীভাবে এতো কথা জানলেন? এখানেই প্রেমেন্দ্র মিত্রের বাহাদুরি। এমনি এমনি কী আর বছরে মাত্র একটা করে ঘনাদার গল্প লিখতেন তিনি!
একেকটি ঘনাদার গল্প লিখতে প্রেমেন্দ্র মিত্র যে কী পরিশ্রম করতেন! প্রথমে ঠিক করতেন, বিজ্ঞানের ঠিক কোন বিষয়টি নিয়ে তিনি গল্প লিখবেন। তারপর সেই বিষয়ের জন্য একটা যুতসই জায়গা ঠিক করতে হতো, যেখানে গল্পটি ফাঁদলে জমবে বেশ। তারপর সেই বিষয়ের পাশাপাশি পড়াশুনা করতে হতো সেই জায়গাটি নিয়েও। একদিকে যেমন বিজ্ঞানের সেই বিষয়টির সঙ্গে জড়িত যাবতীয় তথ্য জানতে হতো, অন্যদিকে তেমনি পড়তে হতো সেই জায়গাটি নিয়েও। সেই জায়গা বা দেশটি কেমন, সেখানকার মানুষের ভাষা কী, তারা কী খায়, কেমন জামাকাপড় পড়ে, তাদের উৎসব কী কী- সব পড়তে হতো তাকে। এতো এতো পড়ার পর সব তথ্য কিন্তু তার কাজেও লাগতো না! শুধু তার গল্প ফাঁদতে, মানে গল্পটিকে বিশ্বাসযোগ্য করতে আমাদেরকে যেটুকু বলা দরকার, সেটুকুই বলতেন তিনি। এমনি করে লেখা হয়েছে একেকটি ঘনাদার গল্প। তাহলে কী দাঁড়ালো? ঘনাদার গল্প পড়লে আমাদের শুধু একটা গাল-গপ্পোই পড়া হচ্ছে না, সেসঙ্গে খানিকটা বিজ্ঞান আর ভ‚গোলও পড়া হয়ে যাচ্ছে, তাই না?
ঘনাদার গল্প ফাঁদার ব্যাপারে প্রেমেন্দ্র মিত্রের বাহাদুরি কিন্তু এতোটুকুতেই সীমাবদ্ধ নয়! ঘনাদার প্রায় প্রত্যেকটি গল্প লেখার সময় প্রেমেন্দ্র মিত্র আরো একটি বিষয়ে নজর রেখেছিলেন। এই যেমন ঘনাদার প্রথম গল্পের কথাই ধরো। যখন তিনি গল্পটি লিখছিলেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ তখন প্রায় শেষের পথে। হঠাৎ করেই একটা দ্বীপ আলোচনায় চলে আসলো- শাখালিন দ্বীপ (তখন দ্বীপটির নাম লেখা হতো সাখালীন)। আগে এই দ্বীপটির মালিক ছিলো রাশিয়া একাই। কিন্তু রুশ-জাপান যুদ্ধে জিতে জাপান দ্বীপটির দক্ষিণের অংশের দখল নিয়ে নেয়। আবার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জিতেই রাশিয়া দ্বীপটির সেই অংশের দখল ফের নিয়ে নেয়। আর তাই সেই সময় দ্বীপটিও চলে আসে আলোচনায়। আর ঘনাদার প্রথম গল্পের জন্য প্রেমেন্দ্র মিত্র এই আলোচিত দ্বীপটিই বেছে নেন।
এখন তো ফ্লাইং সসার নিয়ে আলোচনা প্রায় বন্ধই হয়ে গেছে। এক সময় কিন্তু এই ফ্লাইং সসার নিয়েও খুব হৈ চৈ হয়েছে। বিশেষ করে ৫০’র দশকে এ নিয়ে যে কী হৈ চৈ শুরু হয়েছিলো! সে সময় এই ফ্লাইং সসার নিয়ে প্রেমেন্দ্র মিত্র লিখলেন ‘লাট্টু’।
আবার লেখার বিষয় হিসেবে তিনি বিজ্ঞানের যে সব বিষয় বেছে নেন, সেগুলোও এতো সহজ করে গল্পের মধ্যে বুঝিয়ে দিয়েছেন! গল্পগুলো পড়ার সময় পাঠক যে কতোকিছু বুঝে গেছে, হয়তো টেরও পাওয়া যায়নি। ‘হাঁস’ গল্পে যে ভারি জল নিয়ে সব কাণ্ড, ঘনাদা চলে গিয়েছিলেন হিমালয়ে, সেই ভারি জল কিন্তু পরমাণু বিজ্ঞানের গুরুত্বপূর্ণ এক পদার্থ। আবার ‘ফুটো’ গল্পের ঘটনায় তিনি কী ব্যবহার করেছেন জানো? ফোর্থ ডাইমেনশনের ব্যাপার স্যাপার! এমনি করে নানা গল্পে তিনি ইতিহাস, ভ‚গোল, রসায়ন, পদার্থবিদ্যা, জীববিদ্যা- কতো কিছুই যে তিনি গোপনে আমাদেরকে শিখিয়েছেন! বিজ্ঞানের এই বিষয়গুলোর নাম শুনলেও তো ভয় লাগে। অথচ ঘনাদার গল্পে তুমি কী মজা করেই না এগুলো পড়ে ফেলেছো! তারপরও বলবে, বিজ্ঞান খুব ভয়ের জিনিস? পড়াশুনাটাই বা এমন কী কষ্টের, বলো?
১৯৮৩ সালে ‘কিশোর জ্ঞানবিজ্ঞান’ নামের একটি ছোটদের পত্রিকায় সিদ্ধার্থ ঘোষ নামের একজন প্রস্তাব করলেন- ঘনাদা ক্লাব গঠন করা হোক। এই কাজ করতে জুটে গেল আরো কয়েকজন- রবীন বল, কিন্নর রায়। সবাই মিলে ঠিক করলেন, ক্লাবটি গঠন করা হবে সেই বাড়িতে, যেখানে প্রেমেন্দ্র মিত্র থাকতেন। ১৯৮৪ সালে শার্লক হোমস ক্লাবের মতো করে গঠন করা হলো ‘ঘনাদা ক্লাব’। আর ১৯৮৬ সালে অনেকটা এই ক্লাবেরই অবদানে, আরো স্পষ্ট করে বললে, ওই রবীন বলের চেষ্টায় ‘কিশোর জ্ঞানবিজ্ঞান’ পত্রিকার জুন সংখ্যাটি বের করা হলো শুধুই ঘনাদাকে নিয়ে। আর সেই বিশেষ ঘনাদা সংখ্যায় ঘনাদাকে নিয়ে লেখা হলো মজার মজার সব প্রবন্ধ। লীলা মজুমদার লিখলেন ঘনাদার ভোজনবিলাসিতা সম্পর্কে। আবার ক্ষিতীন্দ্রনারায়ণ ভট্টাচার্য নামের এক শিশু সাহিত্যিক প্রবন্ধ লিখলেন ‘বিজ্ঞানী ঘনাদা’ নামে। আর এই ক্লাব যখন গঠিত হয়, তখনো কিন্তু প্রেমেন্দ্র মিত্র বেঁচেই আছেন; তিনি মৃত্যুবরণ করেন ১৯৮৮ সালে। এর অনেক আগেই অবশ্য তিনি ঘনাদা লেখার জন্য রাজ্য সরকারের শিশু সাহিত্য পুরস্কার পেয়ে গেছেন, ১৯৫৮ সালে।