ইয়েতি রহস্য!

|
প্রথমে আসা যাক ওদের নামের ব্যাপারটায়। ‘ইয়েতি’ নামটা এসেছে তিব্বতি ভাষা থেকে; বাংলা করলে অনেকটা হয় ‘পাথুরে ভল্লুক’! হিমালয়ের মানুষরা আগে বলতো, ইয়েতিরা নাকি সারাক্ষণ বিশাল একটা পাথর নিয়ে ঘুরে বেড়াতো, আত্মরক্ষা নয়তো শিকার করার জন্য। আর শিস দেয়ার মতো এক রকম শব্দ করতো। আর ওই পাথর নিয়ে ঘুরে বেড়ানোর জন্যই হয়তো ওদের নাম দিয়েছিলো পাথুরে ভল্লুক বা ইয়েতি। ওদের এই ‘ইয়েতি’ নামটা জনপ্রিয় হয়ে গেলেও ওদের কিন্তু আরো অনেকগুলো মজার মজার নাম আছে। এই যেমন, ‘মেহ-তেহ’, মানে হলো মানুষ-ভল্লুক! আবার ‘মি-গো’, মানে বনমানুষ! তারপর ‘ক্যাং আদমি’ বা তুষারমানব, ‘জোব্রান’ বা মানুষখেকো।

নামগুলো শুনেই তো বুঝতে পারছো, আগেকার মানুষ ইয়েতিদের যেমন ভয় পেতো, তেমনই শ্রদ্ধাও করতো। ভয় পেতো দেখেই না অনেকে নাম দিয়েছিলো মানুষখেকো। আবার যারা নাম দিয়েছিলো মানুষ-ভল্লুক, তারা কি আর শ্রদ্ধা না করে, ভালো না বেসে এমনি এমনি এমন সুন্দর নাম দিয়েছিলো! হিমালয়ের স্থানীয় কিছু মানুষ তো যাকে বলে ইয়েতিদের এক রকম পূজাই করতো। ইয়েতি ছিলো ওদের শিকারের দেবতা। শুধু তাই না, ওদের বিশ্বাস ছিলো, ইয়েতিদের রক্ত জাদুবিদ্যাতেও দরকারি!

এ তো গেলো সেই জাদুবিদ্যার আমলের গল্প। তখন মানুষের মনে কতোই না কুসংস্কার ছিলো। কিন্তু সে সময় তো ইয়েতিদের কথা হিমালয়ের আশেপাশে নেপাল, ভূটান, ভারত আর তিব্বতেই সীমাবদ্ধ ছিলো। ওখানকার মানুষই ওদের কথা জানতো, ওখানকার মানুষই ওদের ভয় করতো, ওখানকার মানুষই ওদের নিয়ে জল্পনা-কল্পনা করতো। ওদের কথা বিশ্ববাসী জানতে পারে ১৮৩২ সালে। সেই বছর হজসন নামে এক ভদ্রলোক নেপালের হিমালয় ঘুরে এসে লেখেন, তার গাইডরা নাকি এক বিশালাকার ঘন লোমে পুরো শরীর ঢাকা এক অদ্ভূত দু’পেয়ে জন্তু দেখেছে। তবে হজসন ভেবেছিলেন, ওটা ইয়েতি না হয়ে ওরাংওটাং-ও হতে পারে।

ইয়েতির কাহিনী আবারও সবাইকে নাড়া দিয়েছিলো ১৮৯৯ সালে। এবার লরেন্স ওয়াডেল ইয়েতির পায়ের ছাপের কথা বললেন। গাইডদের কাছ থেকে দু’পেয়ে ইয়েতি’দের বর্ণনা শুনে সেটাও সবাইকে বললেন। কিন্তু তাঁর নিজেরই যেন ইয়েতিদের কথা বিশ্বাস হয় না। তুমিই বলো, তোমাকে যদি বলি, হিমালয়ে এমন কতোগুলো প্রাণী আছে, যারা দুই পায়ে হাঁটে আর বড়ো একটা পাথর নিয়ে ঘুরে বেড়ায়, তোমার কি বিশ্বাস হবে? ওয়াডেল বললেন, ওটা তো ইয়েতির পায়ের ছাপ না হয়ে বড়োসড়ো কোনো ভল্লুকের পায়ের ছাপও হতে পারে।

এভাবে আস্তে আস্তে ইয়েতিদের কাহিনী ছড়িয়ে পড়তে লাগলো। আর বাড়তে লাগলো মানুষের আগ্রহ। কী এই ইয়েতি? এরা কি কোনো বিশেষ প্রজাতির প্রাণী? নাকি কোনো বিশেষ প্রজাতির মানুষ, যারা অনেক আগে থেকেই হিমালয়ে বাস করছে বলে শারীরিক গঠন বদলে এরকম হয়ে গেছে? নাকি এরা আসলেই কোনো কিংবদন্তী চরিত্র? মৎসকন্যা না থাকলেও আসলেই হয়তো পৃথিবীতে আছে ইয়েতি, কে বলতে পারে!

আর কী জানো? এরপর থেকে প্রায়ই হিমালয়ে অভিযানকারীরা ইয়েতিদের পায়ের ছাপের দেখা পেতে লাগলেন। অনেকে তো আবার দাবি করতে লাগলো যে, ওরা স্বয়ং ইয়েতিদেরকেই দেখেছে। একজন তো বলেই বসলো, ও একটা ইয়েতিকে গুলি করে খতমও করেছে! কিন্তু বেশিরভাগ দাবিদারের প্রমাণই শেষমেশ ধোপে টিকলো না। দেখা গেলো, কেউ হিমালয়ের ভল্লুকের লোম ইয়েতির লোম মনে করে নিয়ে এসেছে। কেউ আবার কোন ভল্লুকের চামড়াই কষ্ট করে বয়ে নিয়ে এসেছে ইয়েতির চামড়া মনে করে।

১৯৫৩ সাল। স্যার এডমন্ড হিলারি আর শেরপা তেনজিং নোরগে জয় করলেন পৃথিবীর সর্বোচ্চ পর্বত শৃঙ্গ ‘মাউন্ট এভারেস্ট’। আর তারপর অকপটে স্বীকার করে নিলেন, পথে তারা ইয়া বড়ো বড়ো অনেকগুলো পায়ের ছাপ দেখেছেন। আর এই পায়ের ছাপগুলো কিন্তু প্রমাণ হিসেবে নিতান্ত ফেলনা নয়। এই পায়ের ছাপগুলো নিয়ে ভালো রকমের পরীক্ষা-নিরীক্ষাও করা হয়েছে। আর তা করে দেখে গেছে, এগুলো কোনো বানানো পায়ের ছাপও নয়, কিংবা অন্য কোনো প্রাণীর পায়ের ছাপও নয়। অন্য কোনো প্রাণীরই পায়ের ছাপ এতো বড়ো হতে পারে না। আর ওরাংওটাং দু’পায়ে দাঁড়াতে পারলেও দু’পায়ে হাঁটতেই পারে না। আর এই পায়ের ছাপ যেই প্রাণীর, ও চলেই দু’ পা দিয়ে!

১৯৫৪ সালে এক লোক তো ইয়েতির গায়ের লোমই নিয়ে চলে আসলো। আর বিজ্ঞানীরা পরীক্ষা করে দেখেন কি, ওটা কোনো ভল্লুকেরও লোম তো নয়ই, অন্য কোনো পরিচিত প্রাণীর লোমও নয়!

১৯৭০ সাল। বৃটিশ পর্বতারোহী ডন উইলিয়ামস হিমালয়ের অন্নপূর্ণা শৃঙ্গে উঠছিলেন। হঠাৎ তিনি শোনেন কি, কে যেন কাঁদছে! তার গাইড শেরপাকে জিজ্ঞেস করলেন, ঘটনা কি? শেরপা বললো, ওটা নাকি ইয়েতির ডাক। পরে ওই রাতেই নাকি তিনি দেখেন, কী যেন এক বিশাল দু’পেয়ে জন্তু তাদের ক্যাম্পের আশেপাশেই ঘুরঘুর করছে। সকালে উঠে তিনি ওই জন্তুটির ইয়া বড়ো বড়ো পায়ের ছাপও দেখেন। ঠিক ওই আগের পায়ের ছাপগুলোর মতোই। আর পরের দিন সন্ধ্যাবেলা নাকি তিনি বাইনোকুলার দিয়ে প্রায় ২০ মিনিট ধরে দেখেন ইয়েতিটাকে; দু’পেয়ে বনমানুষের মতো একটা প্রাণী তাদের ক্যাম্পের আশেপাশেই খাবারের সন্ধানে ঘুরে বেড়াচ্ছে।

এমনি করে দিন দিন ইয়েতি রহস্য আরো ঘনীভূত হচ্ছিলো। আর যেখানেই রহস্য, সেখানেই রহস্য উদ্ঘাটনের জন্য চলে আসেন বিজ্ঞানীরা। এখানেও তাই হলো। বিজ্ঞানীরা ইয়েতি রহস্য উদ্ঘাটনের জন্য আরো বেশি ক্ষেপে উঠলেন। সেই সঙ্গে ক্ষেপে উঠলেন সত্যসন্ধানী দুঃসাহসী সব অভিযাত্রীরাও। ২০০৭ সালে আমেরিকান টিভি উপস্থাপক জশুয়া গেটস তাঁর এক বিশাল দল নিয়ে চলে আসলেন নেপালে; উদ্দেশ্য- ইয়েতি রহস্য উদ্ঘাটন। অনেক ঘুরে ঘুরে তারা শুধু ইয়েতিদের পায়ের ছাপই পেলেন। আগেই তো বলেছি, ওদের পায়ের ছাপকে মোটেও হেলাফেলা করো না। সে কী আর যে সে পায়ের ছাপ! একেকটা পায়ের ছাপ লম্বায় ৩৩ সেমি, পাশে ২৫ সেমি! এরপর তাদের দল হিমালয়েরই আরেক জায়গায় গেল ইয়েতি খুঁজতে। এবারও তারা পেল শুধুই পায়ের ছাপ। আর দুটো পায়ের ছাপ মিলিয়ে তারা বেশ মিলও পেলো। এমনকি, পায়ের ছাপগুলো এতোই নিখুঁত ছিলো, তারা বলেই দিলো, এই পায়ের ছাপ কোনো দুষ্টু মানুষ বানাতেই পারে না। এটা অবশ্যই সত্যিকারের কোনো প্রাণীরই পায়ের ছাপ।

এর কিছুদিন পর গেটসের দল আবারও গেল হিমালয়ে। আর এবার তারা পেল ইয়েতির কিছু লোম। পরীক্ষা করে জানা গেলো, এটা এক অচেনা প্রাণীর লোম; পরিচিত কোনো প্রাণীর লোমের সঙ্গেই এই লোমের মিল নেই।

আর ২০০৮ সালে কয়েক জন জাপানি অভিযাত্রী তো ইয়েতিদের পায়ের ছাপের ছবি-ই তুলে নিয়ে আসলো। তাদের যে দলনেতা, ইয়োশিতেরো তাকাহাসি, তিনি নাকি ২০০৩ সালে হিমালয়ে গিয়ে একটা ইয়েতিকে দেখেও ছিলেন! তার ইচ্ছা, ইয়েতির ছবি বা ভিডিও করে নিয়ে আসা।

এমনি করে ইয়েতিদের নিয়ে মানুষের জল্পনা-কল্পনা চলছেই। কখনো তাদের পায়ের ছাপ পাওয়া গেছে, কখনো পাওয়া গেছে তাদের লোম। কিন্তু মানুষ কোনো ভাবেই তাদের দেখতে পাচ্ছে না। আর দেখলেও তার কোনো প্রমাণও রাখতে পারছে না। আর অনেক দুষ্টু মানুষ তো আবার এই সুযোগে ইয়েতিদের দেখার কথা বানিয়ে বানিয়ে বলে সবাইকে ধোঁকাও দিয়েছে। তবে বিজ্ঞানীরা কিন্তু বসে নেই। তারা কিন্তু ঠিকই ইয়েতিদের নিয়ে গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন। তাদের অনেকের মতে, ওরা আসলে হিমালয়ের কিছু বিরল প্রজাতির ভল্লুক। আর দিন দিন ওদের সংখ্যাও আরো কমে যাচ্ছে। তাই এখন আর মানুষ তাদের দেখতে পারে না। আবার অনেকে বলে, ওরা যেই বিশেষ প্রজাতির ভল্লুক, তারা আবার চাইলে দু’পায়েও হাঁটতে পারে, চাইলে চার পায়েও হাঁটতে পারে। আর ওদের এই দু’পায়ে হাঁটাটাই আমাদেরকে যতো ধাঁধায় ফেলে দিয়েছে।
তবে ইয়েতিরা ভল্লুক হোক, আর নতুন কোনো প্রাণীই হোক, আর চাই কি পরিবর্তিত হয়ে যাওয়া মানুষই হোক, ওদের নিয়ে মানুষের আগ্রহের কিন্তু কমতি নেই। দেখো না, শুধু ওদের নিয়েই মনে হয় আধা ডজন ছবি বানানো হয়েছে! একগাদা টিভি সিরিজেও উপস্থিত ইয়েতিরা, আছে অনেক বিখ্যাত বইয়েও। ওয়াল্ট ডিজনি’র থিমপার্ক ডিজনিল্যান্ডে তো ওদের নিয়ে দুটো রাইড-ই আছে! এমনকি ওদের নিয়ে গানও কম লেখা হয়নি। হেভি মেটাল ব্যান্ড ‘হাই অন ফায়ার’-র একটা গানই আছে নাম ‘দ্য ইয়েতি’। একই নামের গান আছে রক ব্যান্ড ‘ক্ল্যাচ’-র। আর একটা সাইকাডেলিক অ্যালবামও বের করা হয়েছিলো ওদের নিয়ে, নাম ‘দ্য মিস্ট্রি অফ দ্য ইয়েতি’। মানে ব্যান্ড জগতেও ইয়েতিদের নিয়ে কম জল্পনা-কল্পনা হয়নি। বিশ্ববিখ্যাত ব্যান্ড ‘বিটলস’ তো ইয়েতিদের নিয়ে একটা মজার গানই বেঁধেছিলো, তার দু’টো লাইন শোনোই না- ‘ওর উচিত ইয়েতিকে বিয়ে করা,/ কারণ ও এত্তো জঘন্য স্প্যাগেত্তি রান্না করে!’ মানে ওই জঘন্য স্প্যাগেত্তি ইয়েতি ছাড়া আর কেউ-ই নাকি খেতে পারবে না!

যাই হোক, ইয়েতিদের তো অনেক গল্প শুনলে, কিভাবে ওদের পায়ের ছাপ পাওয়া গেছে, আর বারবার মানুষ ওদের লোম কি চামড়া মনে করে নিয়ে এসেছে ভল্লুকের লোম, না হয় চামড়া। তবে অনেকবার কিন্তু এমন লোমও পাওয়া গেছে, যেগুলো আসলে ভল্লুকেরই লোম, নাকি অন্য কোনো প্রাণীর লোম, সেটা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। আর ওদের পায়ের ছাপের ব্যাপারটাও তো এক বিরাট রহস্য! আর তাই আমাদেরকেও সেই রহস্যেই থাকতে হচ্ছে, আসলেই এই ইয়েতিরা কারা? ভল্লুক, অন্য কোনো প্রাণী, নাকি মানুষের বিবর্তিত রূপ? জানতে হলে অপেক্ষা করা ছাড়া কোনো গতি নেই। আগে তো বিজ্ঞানীরা সেটা খুঁজে বের করুক, নাকি!

Blogger templates

.
Recommended Post Slide Out For Blogger