ইনকাদের হারিয়ে যাওয়া শহর

|
মাচু পিচু মানে পুরোনো চূড়ো
মাচু পিচু! নামটাই কেমন অদ্ভুত, তাইনা? আসলে আজকে আমরা যে সব জিনিসের নাম জানবো তাদের সবগুলোর নামই বেশ অদ্ভুত। এমনকি ইনকাদের প্রাচীন এই ভাষাটিরও নাম বেশ অদ্ভুত- ‘কুয়েচুয়া’ ভাষা। কুয়েচুয়া ভাষায় মাচু পিচু শব্দের অর্থ হচ্ছে ‘পুরোনো চূড়ো’। পাহাড়ের চূড়ায় তৈরি করা হয়েছিলো বলেই হয়তো তারা শহরটির এমন নাম দিয়েছিলো। শুনলে অবাক হতে হয়, মাচু পিচু শহরটি নাকি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ২,৪০০ মিটার  (৭,৮৭৫ ফিট)  উঁচুতে অবস্থিত। অর্থাৎ কিনা, আমাদের দেশের সর্বোচ্চ চূড়া তাজিনডং-এরও (১২৩১ মিটার) প্রায় দ্বিগুণ উচ্চতায়! এতো উঁচুতে কিভাবে তারা একটা আস্ত শহর তৈরি করে ফেললো সেটাই কিন্তু একটা বিরাট ভাবনার বিষয়।
তাও আবার সেই কত্তো বছর আগে। মাচু পিচু নির্মিত হয় প্রায় ৫৫০ বছর আগে, ১৪৫০ সালের দিকে। এর একশো বছর পরেই স্প্যানিশরা ইনকা সভ্যতা আক্রমণ করে। ধ্বংস করে ফেলে তাদের বেশীরভাগ শহরই। কিন্তু কী আশ্চর্যের কথা, ওরা নাকি মাচু পিচু শহরটি খুঁজেই পায়নি! ওরা হয়তো ভাবতেই পারেনি যে পাহাড়ের এতো উঁচুতে কোনো শহর থাকতে পারে। এদিকে মানুষজন না থাকার কারণে শহরটিও ধীরে ধীরে পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে। কয়েক শ’ বছর ধরে তো মানুষ এই ঐতিহাসিক শহরটিকে খুঁজেই পায়নি। এরপর ১৯১১ সালে হাইরাম বিংহাম নামের এক মার্কিন ঐতিহাসিক মাচু পিচু শহরটি আবিষ্কার করেন। সেও এক মজার গল্প। আরেকদিন সুযোগ পেলে সেই আবিস্কারের গল্পও তোমাদের কাছে করা যাবে। আজকে শুধু মাচু পিচুর গল্পই শোনো।



কোথায় এই হারানো শহর?
মাচু পিচু যেতে হলে তোমাকে সবার প্রথমে যেতে হবে পেরুতে। শহরটা সে দেশেই অবস্থিত কিনা! আন্দিজ পর্বতমালার যে অংশটুকু পেরুতে পড়েছে সেখানকারই এক পর্বতের চূড়ায় এর অবস্থান। সেই পাহাড়টির নাম হয়ে গেছে মাচু পিচু। আর শহরটির অবস্থানও ছিলো খুব সুরক্ষিত। অন্যরা তো এই শহর সহজে খুঁজে পাবেই না, আর যদি পায়ও, আক্রমণ করে তেমন সুবিধা করতে পারবে না। পাহাড়ের এক পাশ চূড়া থেকে একেবারে খাড়া ভাবে ৬০০ মিটার নিচে উরুবাম্বা নদীর পাদদেশে গিয়ে মিশেছে। অন্যদিকে হুয়ানা পিচু নামের আরেকটি পর্বত খাড়া উঠে গেছে আরও কয়েক হাজার ফিট উঁচুতে। সুতরাং দুই দিক দিয়েই শহরটি প্রাকৃতিকভাবেই বেশ নিরাপদ ছিলো।

এতক্ষণে নিশ্চয়ই তোমাদের মনে একটা প্রশ্নের উদয় হয়েছে- কি এমন কারণ ছিলো যে, ইনকারা পাহাড়ের ঐ উঁচু চূড়ায় এমন ভয়ংকর একটা জায়গায় এত্তো সুন্দর একটা শহর তৈরি করতে গেলো? কি, মাথা চুলকাচ্ছো? আসলে তোমার মতো অনেক বিশেষজ্ঞরও বহু বছর ধরেই এভাবে মাথা চুলকাচ্ছে। কিন্তু কেউই একমত হতে পারেনি। হাইরাম বিংহাম এবং আরও অনেকের মতে এই সুরক্ষিত শহরটি ইনকাদের ঐতিহ্যগত জন্মস্থান, নয়তো সূর্য কুমারীদের পবিত্র কেন্দ্র ছিলো। আবার অনেকের ধারণা, এটি ব্যবহৃত হতো ভয়ংকর অপরাধীদের জেলখানা হিসেবে! অনেকে আবার এও মনে করেন, এটি আসলে ছিলো ইনকা সম্রাটদের একটি অবকাশযাপন কেন্দ্র। বেশিরভাগ মানুষেরও এটাই ধারণা। তবে জ্যোতির্মণ্ডলীয় নানা ঘটনা পর্যবেক্ষণের জন্য এই শহরটি খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিলো। আর সামরিক দিয়ে যে শহরটি বেশ সুর¶িত ছিলো সে তো আগেই বলেছি। ঐ যে, শহরটি যে প্রাকৃতিকভাবেই খুব নিরাপদ ছিলো। 

মাচু পিচুর তিনটি ভাগ
এবার চলো, চোখ বন্ধ করে একবার ঘুরে আসি মাচু পিচু শহর থেকে। দেখে আসি কতোটা সুন্দর ছিলো ইনকাদের এই শহর। প্রত্নতাত্ত্বিকরা মনে করেন, পুরো মাচু পিচু শহরটি তিনটি প্রধান অংশে বিভক্ত ছিলো। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশটির নাম তারা দিয়েছেন ‘পবিত্র এলাকা’। নাম শুনেই নিশ্চয়ই বুঝতে পারছো যে, এই জায়গাটি ইনকাদের কাছে ছিলো খুবই পবিত্র। পবিত্র হওয়ার কারণও আছে। ইনকাদের ধর্মীয় যতো পবিত্র স্থাপনাগুলো, সব যে এই জায়গাতেই ছিলো। সেগুলোর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ইন্তিওয়াতানা পাথর, সূর্য মন্দির এবং তিন জানালা বিশিষ্ট ঘর। ইনকাদের সূর্যদেবতা, আর যতো মহান দেবতা ছিলো তাদের প্রতি এই পবিত্র স্থাপনাগুলো উৎসর্গ করেছিলো ওরা। আর ওদের পূজা-অর্চনাও ওরা এখানেই সম্পন্ন করতো। নিশ্চয়ই কৌতূহল হচ্ছে যে, ইনকারা কোন কোন দেবতার পূজা করতো? বলছি শোনো। ইনকাদের প্রধান দেবতা ছিলো সূর্যদেবতা। অর্থাৎ, তারা সবচেয়ে বেশি  পূজা করতো সূর্যের। আসলে প্রাচীনকালে প্রায় সব অঞ্চলের মানুষেরই প্রধান দেবতা ছিলো সূর্যদেবতা, সে মিশরের কথাই বলো, রোমের কথাই বলো, গ্রিসের কথাই বলো, আর আমাদের উপমহাদেশের কথাই বলো। আমাদের উপমহাদেশে হিন্দুধর্ম উদ্ভব হওয়ার আগে যে লোকজ বা আঞ্চলিক ধর্ম ছিলো, সেখানেও সবচেয়ে বড়ো দেবতা ছিলো সূর্যদেবতা।


যাই হোক, আমরা মাচু পিচু’র গল্পে ফিরে আসি। মাচু পিচু’র আরেকটি অংশ ব্যবহৃত হতো জনসাধারণের থাকার জন্য। এই অংশটি শহরের দক্ষিণ দিকে অবস্থিত। সাধারণত নিম্নশ্রেণীর লোকজনই এখানে বসবাস করত। এখানকার স্থাপনাগুলোর মধ্যে বেশীরভাগই গুদামঘর আর সাধারণ বসতবাড়ি। মাচু পিচু শহরের অন্য অংশটুকু ছিলো অভিজাত এলাকা। অর্থাৎ এখানে সব অভিজাত শ্রেণীর লোকজন বাস করতো। এই অংশটুকু কিন্তু তুমি খুব সহজেই চিনতে পারবে। একটা ঢালের উপর কয়েক সারিতে অবস্থিত এখানকার বাড়িগুলো। মজার ব্যাপার কি জানো, বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষদের জন্য ইনকাদের তৈরি ঘরগুলোর চেহারাও ছিলো বিভিন্ন রকম। এই যেমন ধরো, ‘হামাউতা’ বা জ্ঞানী লোকদের বাড়িগুলোর দেয়াল ছিলো লালচে রঙের। আবার ‘নিউস্তা’ বা রাজকুমারীদের ঘরগুলো ছিলো অসম আয়তাকার আকৃতির, মানে আয়তাকার ঘর, কিন্তু একেক দেয়ালের দৈর্ঘ্য একেক রকম। এছাড়াও এই এলাকায় খোদাই করা একটা স্মৃতিসৌধ ছিলো, যার ভেতরে একটা নকশা করা ঘরও আছে। সাধারণত যজ্ঞ আর উৎসর্গ করার কাজে এ ঘরটা ব্যবহার করা হত।

পাথরের তৈরি ঘরবাড়ি
ইনকাদের তৈরি ঘরবাড়িগুলোর সাথে কিন্তু আমাদের আজকালকার তৈরি ঘরবাড়িগুলোর একদমই মিল খুঁজে পাবে না। যদি মনে করে থাকো যে, ইনকারাও এখনকার মত ইট-কাঠ-সিমেন্ট-সুড়কি-কংক্রিট দিয়ে ঘরবাড়ি তৈরি করতো তাহলে কিন্তু একদম ভুল করবে। আসলে এতো আগে তো ইট-সুড়কি-সিমেন্ট-কংক্রিট আবিষ্কারই হয়নি। তাহলে ওরা কি দিয়ে ঘরবাড়ি বানাতো? আসলে ইনকারা তাদের বাড়িগুলো তৈরি করতো পাথর দিয়ে। পাথর দিয়ে বাড়ি নির্মাণে ওরা ছিলো খুবই দক্ষ। পাথর বাড়ি বানালো, তা না হয় মেনে নিলে, কিন্তু পাথর তো জোড়া দিতে হবে, নাকি? ওরা পাথরগুলো জোড়া দিতো কি দিয়ে? কিছু না, স্রেফে কিচ্ছু না! আসলে পাথর দিয়ে বাড়ি তৈরির জন্য ওরা পাথরগুলো এতো নিখুঁতভাবে কাটতো যে কোনোরকম বালি, সিমেন্ট বা অন্য কোনো কিছু ছাড়াই ওগুলো একদম খাঁজে খাঁজে শক্তভাবে বসে যেতো। আর এই পাথরের দেয়ালগুলোর জোড় এতোটাই নিখুঁত যে একটা পাতলা ছুরির ফলাও জোড়গুলোর ভেতর দিয়ে প্রবেশ করানো যায় না! তাহলেই বোঝো, কি পরিমাণ দক্ষ ছিলো তারা এই কাজে! 


ভূমিকম্প সামলাতে যতো কৌশল
ইনকাদের ঘরবাড়িগুলো দেখলেই বুঝতে পারবে যে ওরা ছিলো এক একজন যাকে বলে পাকা ইঞ্জিনিয়ার। মাচু পিচু শহরের বাড়িগুলোই তার বড় প্রমাণ। এটা হয়তো জানো, পেরু খুবই ভূমিকম্পপ্রবণ অঞ্চল। এখানে প্রায়ই বড় বড় ভূমিকম্পে প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়। এই ব্যাপারটা মাথায় রেখেই ইনকারা অনেক বুদ্ধি করে তবেই ওদের বাড়িগুলো তৈরি করেছিলো। সিমেন্টজাতীয় মিশ্রণের গাঁথুনির চাইতে পাথরে পাথর বসিয়ে তৈরি গাঁথুনি অনেক বেশি ভূমিকম্প প্রতিরোধী। তাই ওরা ওদের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলো এভাবেই তৈরি করতো। আরেকটা আশ্চর্য তথ্য দেই তোমাদেরকে; ইনকাদের তৈরি বাড়ির দেয়ালগুলোতে তুমি প্রচুর সূক্ষ নকশা দেখতে পাবে। এই নকশাগুলো কিন্তু শুধু সৌন্দর্যের জন্যই করা হয়নি, অন্য কারণও আছে। অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি, এই সূক্ষ নকশাগুলিই ভূমিকম্পের সময় দেয়াল ধ্বসে পড়া অনেকাংশে রোধ করে। কি, অবাক হয়ে গেলে নাকি? তাহলেই চিন্তা করো, এই নকশাগুলো তৈরি করতে ইনকারা কতোখানি মাথা খাটিয়েছিলো! তার উপর দেখবে যে, সবগুলো দেয়াল একদম সোজা নয়। দেয়ালগুলোর একটা সারি অন্য সারি থেকে একটুু হেলানো। ভেবো না যে, এগুলো বাতাসে হেলে পড়েছে। ওরা ইচ্ছে করেই দেয়ালগুলো এভাবে তৈরি করেছে। কেন? এর ফলে দেয়ালগুলোর ভারসাম্য রক্ষা হয়েছে, ফলে ভূমিকম্পে এগুলো সহজে ধ্বসে পড়বে না।

পাথর পাহাড়ে উঠলো কিভাবে!
এতক্ষণে নিশ্চয়ই বুঝে ফেলেছো যে, মাচু পিচু শহরের বাড়িগুলো বেশ বড় বড় সাইজের পাথর দিয়ে তৈরি। এমনকি, মাচু পিচুতে ওঠার জন্য যে সিঁড়ি, সেগুলোও পাথরের। তার উপর বেশ কয়েকটা সিঁড়ি তো আস্ত আস্ত এক একটা গ্রানাইট পাথর কেটেই বানানো হয়েছে। এখন নিশ্চয়ই ভাবছো, পাহাড়ের এই এত্তো এত্তো উঁচুতে এত্তো বড়ো বড়ো আকারের পাথরগুলো ওরা কিভাবে তুললো? আসলেই তো! কিভাবে তুললো? ভাববার মতই একটা বিষয়। এরকম বড়ো বড়ো পাথর পাহাড়ের চূড়ায় তোলা কি আর চাট্টিখানি কথা! এর জন্য শক্তিশালী আধুনিক কতো যন্ত্রপাতির দরকার হয়! অথচ মেশিন তো দূরে থাক, ইনকারা কখনও তাদের কাজে কর্মে চাকাই ব্যবহার করেনি! তাহলে কিভাবে ওরা এতো বড়ো বড়ো আকৃতির এতোগুলো পাথরখণ্ড পাহাড়ের এত্তো উঁচুতে উঠালো? সেটি আসলেই একটা রহস্য। বিজ্ঞানীরা এর কোন সুরাহা-ই করতে পারেন নি। শেষমেশ তারা ধারণা করেছেন, শত শত শ্রমিককে কাজে লাগিয়ে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে বেয়ে পাথরগুলোকে উপরে তোলা হয়েছিলো।   
ইন্তিওয়াতানা পাথর- পবিত্র পাথর নাকি সূর্যঘড়ি?
ইন্তিওয়াতানা পাথরের কথা মনে আছে? ঐ যে বললাম, মাচু পিচুর ‘পবিত্র এলাকা’র অন্যতম নিদর্শন। কিন্তু কি কারণে এই পাথর পবিত্র এলাকায় স্থান পেলো আর কী-ই বা এর বিশেষত্ব? বলছি শোনো- যেহেতু পবিত্র এলাকায় অবস্থিত সেহেতু বুঝতে পারছো, এই পাথরটি ইনকাদের কাছে ধর্মীয় কারণে খুবই পবিত্র ছিলো। ওদের বিশ্বাস অনুসারে, কোনও অনুভূতি সম্পন্ন মানুষ যদি এই পাথরে তার কপাল ঘষে তাহলে সে আধ্যাত্মিক জগৎ দেখতে পাবে। অর্থাৎ, তুমি যদি এই পাথরে তোমার কপালটা একটু ঘষে দাও, তাহলে তুমি অন্য এক জগতে পৌঁছে যাবে। হয়তো তুমি তোমার অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎও দেখতে পাবে। এমনটি হলে তো সত্যি খুব মজার বাপার, তাই না? দক্ষিণ আমেরিকার মানুষ যে কয়েকটি পাথরের পূজা করতো বা এখনও করে সেগুলোর মধ্যে ইন্তিওয়াতানা পাথর বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তবে ইনকা সভ্যতা আক্রমণের সময় স্প্যানিশরা বেশীরভাগ পবিত্র পাথরই ধ্বংস করে ফেলে। কী খারাপ কথা! ওগুলো থাকলে কত্তো ভালো হতো। ওই সব পাথর দেখতে দেখতে প্রাচীনকালের এই সব গল্প শুনতে কতোই না ভালো লাগতো!


তবে বেঁচে গেছে মাচু পিচুর ইন্তিওয়াতানা পাথর। নিশ্চয়ই বুঝতে পারছো কেন? আরে! স্প্যানিশরা তো মাচু পিচু শহরটিই খুঁজে পায়নি। তাহলে আর ইন্তিওয়াতানা পাথর কিভাবে খুঁজে পাবে বলো? পাহাড়ের চূড়ায় নির্মিত হওয়ার কারণেই ধ্বংসের হাত থেকে বেঁচে গেছে এই পাথর। তবে ইন্তিওয়াতানা পাথরের কিন্তু আরেকটি বিশেষত্ব আছে। ইন্তিওয়াতানা পাথর আসলে একটি ‘মহাকাশ ঘড়ি’। মহাকাশ ঘড়ি কি বুঝতে পারছো না? দাঁড়াও, এই ঘড়ির আরেকটা নাম আছে- সূর্যঘড়ি। আকাশে সূর্যের বিভিন্ন অবস্থানের কারণে এই পাথরের ছায়ার পরিবর্তন দেখে সময় নির্ণয় করা হতো। তখন তো আর ঘড়ি ছিলো না যে সময় দেখতে চাইলেই চট করে ঘড়ির ডায়ালে দেখে নেবে। তাই আগে এরকম সূর্যঘড়ি তৈরি কর হতো। আমাদের দেশেও এরকম অনেকগুলো সূর্যঘড়ি আছে। আর জাদুঘরগুলোতে তো আছেই। দেখতে চাইলে আগারগাঁয়ের বিজ্ঞান জাদুঘরেই যেতে পারো। যাই হোক, মাচু পিচুর এই ইন্তিওয়াতানা পাথরের কিন্তু আরেকটা মজা আছে। ১১ নভেম্বর ও ৩০ জানুয়ারি- বছরের এই দু’দিনের ঠিক মাঝামাঝি সময়ে, মানে ঠিক দুপুর ১২টায়, সূর্য ইন্তিওয়াতানা পাথরের একেবারে ওপরে থাকে; ফলে এর কোনও ছায়াই তৈরি হয় না! একারণেই এটিকে বলা হয় ‘সূর্যের আঁকড়া বিন্দুও’। অর্থাৎ যেটি কিনা সূর্যকে আঁকড়ে ধরে রাখে। এই বিশেষত্বের কারণেই স্থানীয় উপকথায় বলা হয় যে, এই পাথর নির্মাণ করাই হয়েছিলো সূর্যকে আটকে রাখার জন্য। যদিও প্রকৃতপক্ষে ব্যাপারটা একদমই সম্ভব নয়। কিন্তু আগে তো মানুষ কতো কিছুই বিশ্বাস করতো। তখন তো আর মানুষ এত্তো কিছু জানতো না! তখনকার সবচেয়ে জ্ঞানী লোকটিও হয়তো তোমার থেকেও কম জানতো। তাই বলে তাদের জ্ঞানকে আবার খাটো করে দেখতে যেও না, ওরা যদি এভাবে জানার চেষ্টা না করতো, তাহলে কি আর আজকে মানুষ এই অবস্থানে আসতে পারতো?
মাচু পিচুর যতো স্বীকৃতি
মাচু পিচু শহরকে মানুষের আগ্রাসন থেকে রক্ষা করার জন্য পেরু সরকার ১৯৮১ সালে এটিকে ‘সংরক্ষিত ঐতিহাসিক এলাকা’ হিসেবে ঘোষণা করে। আর ১৯৮৩ সালে তো ইউনেস্কো মাচু পিচুকে ‘ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট’ হিসেবেই ঘোষণা করেছে। আর ২০০৭ সালে তো রীতিমতো পৃথিবীর মানুষের ভোট নিয়ে ঘোষণা করা বর্তমান পৃথিবীতে টিকে থাকা ৭ আশ্চর্যের তালিকাতেই নাম উঠে যায় মাচু পিচুর। এখন এতো সুন্দর একটা জায়গা যদি মানুষের অত্যাচারে ধ্বংস হয়ে যায় তাহলে নিশ্চয়ই খুব দুঃখের বিষয় হবে, তাইনা? আর অতিরিক্ত মানুষের আনাগোনার কারণে মাচু পিচু কিন্তু সত্যি এখন হুমকির মুখেই আছে। এজন্য ২০০৮ সালে ওয়ার্ল্ড মনুমেন্টস ফান্ড মাচু পিচুকে ‘বিশ্বের সবচাইতে বিপন্ন ১০০টি স্থান’ এর তালিকাতেও রেখেছিলো। তবে, পেরুর সরকার কিন্তু মাচু পিচুর অনেক যত্ন-আত্তিও করছে।

কি, মাচু পিচুর গল্প শুনে ওখানে যেতে ইচ্ছে করছে নাকি? গেলে কি মাচু পিচুর অমীমাংসিত রহস্যগুলোর সমাধান করতে পারবে? না পারলেই বা কি! রহস্য থাকলেই না মজাটা আরো বেশি জমে। তখন রহস্য, রোমাঞ্চ আর অ্যাডভেঞ্চার- তিনে মিলে একদম জম্পেশ মজা হয়। আর এই তিনটা একসঙ্গে পেতে চাইলে মাচু পিচু কিন্তু খুবই লোভনীয়। আর তাই তো মাচু পিচু মানুষের এত্তো প্রিয়।

Blogger templates

.
Recommended Post Slide Out For Blogger