হারিয়ে যাওয়া প্রাণীদের রাজ্যে

|
  
কাগা: অর্ধেক জেব্রা, অর্ধেক ঘোড়া
না না, সুকুমার রায়েরায়ের কল্পনার হাঁসজাড়ুর কথা বলছি না; সত্যিই একসময় পৃথিবীতে কাগা নামের একটি প্রজাতির জেব্রা ছিলো, যাদের দেহের অর্ধেকটা দেখতে ছিলো ঠিক ঘোড়ার মতো। আফ্রিকার গহীন অরণ্যে স্বাধীনভাবে দল বেঁধে ঘুরে বেড়াতো এরা। কিন্তু মানুষ নামের সবচেয়ে ‘বুদ্ধিমান’ প্রাণীদের অত্যাচারে আঠারো শতকের শেষের দিকেই এরা বিদায় নেয় এই ধরাধাম থেকে।


আজ যেখানে দক্ষিণ আফ্রিকার কেপ প্রদেশটি অবস্থিত, এক সময় সেখানেই ছিলো কাগার বিচরণস্থল। কেপ থেকে অরেঞ্জ ফ্রি স্টেটের দক্ষিণ ভাগ পর্যন্ত ছিলো এদের বিস্তৃতি। দৈহিক গরণে আর দশটা সাধারণ জেব্রার মতো হলেও কাগার ঐ অনন্য বৈশিষ্ট্যই সবার থেকে আলাদা করে রাখতো একে। এর শরীরের সামনের অংশটি জেব্রাদের মতোই ডোরাকাটা। তবে সাদা কালোর বদলে বাদমি কালো ডোরাতেই ভরে থাকতো সেখানটা। আর পেছনের দিকটা ছিলো ঠিক বাদামি রং এর ঘোড়ার মতো। আর পেটের অংশটা সাদাটে।


নিরামিষভোজি এই নিরীহ প্রাণীটিকেই মাংসের লোভে নির্বিচারে শিকার করতে শুরু করে মানুষেরা। আর এভাবেই সতেরো শতকের শেষের দিক থেকেই একটু একটু করে বিলুপ্তির পথে এগুতে থাকে কাগা। এমনকি শেষ বুনো কাগাটিকেও ১৮৭০ সালে গুলি করে মেরে ফেলা হয়। নিজেদের জাতভাইদের এভাবে হারিয়ে যাওয়াটা মেনে না নিতে পেরেই হয়তো পৃথিবীর সর্বশেষ কাগাটি মারা যায় ১৮৮৩ সালে আমস্টারডামের আর্টিস মাগিস্ত্রা নামের একটি চিড়িয়াখানায়।


সাগরের অবলা প্রাণী: স্টেলার্স সি কাউ
সমুদ্রের নীল জলের নিচেও একটা সময় গরুরা বাস করতো! কী, চমকে উঠলে নাকী? চমকে ওঠার মতোই কথা বটে। তবে সিত্যকারের গরু নয়, স্টেলার্স সি কাউ নামের গরুদের মতো দেখতে বিশাল আকারের এক অবলা নিরীহ প্রজাতির প্রাণী একসময় সাঁতরে বেড়াতো বেরিং সাগরসহ উত্তর প্রশান্ত মহাসাগরের উপকূলের অনেকটা জায়গা জুড়ে।

সাগরতলের এই প্রাণীটিকে প্রথম আবিষ্কার করেন প্রকৃতিবিদ জর্জ স্টেলার। ১৭৪১ সালে অভিযাত্রিক বন্ধু ভিতাস বেরিং (এর নামেই নামকরণ করা হয়েছে বেরিং সাগরের) এর সঙ্গে সমুদ্রে ঘুরছিলেন স্টেলার; তখনই তিনি আবিষ্কার করেন প্রায় ২৫ ফুট লম্বা, বিরাট আকারের এই জলচর প্রাণীটিকে। সি কাউয়ের বর্ণনা করতে গিয়ে স্টেলার বলেছেন, ‘প্রাণীটি কখনোই ডাঙ্গায় আসে না, সবসময় জলেই থাকে। এটির চামড়া ওক গাছের বাকলের মতোই পুরু এবং কালো; তবে এর বিশাল বপুর তুলনায় মাথাটা বেশ ছোটই। এটির মুখ দাঁতবিহীন, তবে সমান দুটি সাদা রঙের হাড় আছে মুখের গহ্বরের ওপরে ও নীচে।’


নাম সি কাউ হলেও গরুদের মতো বাঁকা শিং কিন্তু এদের ছিলো না। আর স্বভাব চরিত্রেও এরা ছিলো নিতান্তই ভোলাভালা। ২৫.৯ ফুট লম্বা বিশাল বপুর শেষ প্রান্তে থাকতো তিমিদের মতোন বিরাট এক চওড়া লেজ। সিল মাছের মতো সামনের দিকে দুটো পাও ছিলো এদের।

প্রশান্ত উপকূলে মানব বসতি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গেই এদের সংখ্যা কমতে শুরু করে। ১৭৬৮ সালের দিকে সংখ্যাটা কমতে কমতে শূণ্যের কোঠায় নেমে যায়। বিলুপ্ত প্রাণীদের খাতায় তখন থেকেই নাম ওঠে এই নিরীহ প্রাণীটির।

এখনো অবশ্য মাঝে মাঝে শোনা যায় সি কাউ দেখতে পাওয়ার কথা। যদিও এসব উড়ো খবরের কোন ভিত্তি আজ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি; তবুও এগুলোই সি কাউদের টিকে থাকা নিয়ে ক্ষীণ একটি আশা বাঁচিয়ে রেখেছে। কোনোদিন যদি এরকম একটা উড়ো খবর সত্যি হয়েই যায়, তখন কী ভালোই না হবে!

দৈত্য হরিণ আইরিশ এল্ক
ম্যামথদের কথা শুনেছো তো নিশ্চয়ই? হাজার হাজার বছর আগে হাতিদের পূর্বপুরুষ এই দৈত্যাকৃতির রোমষ হাতি বিলুপ্ত হয়ে যায় পৃথিবী থেকে। হাতিদের ইতিহাসে ম্যামথ যেমন, হরিণদের ইতিহাসে তেমনি রয়েছে আইরিশ এল্ক। দৈত্যাকারের এই হরিণ আজ থেকে সাড়ে সাত হাজার বছর আগেও দাপিয়ে বেড়াতো ইউরোপের আয়ারল্যান্ড থেকে এশিয়ার বৈকাল হ্রদ পর্যন্ত।

দানব আকৃতির এল্ক হরিণেরা বিখ্যাত ছিলো তাদের বিরাট আকারের শিং এর জন্য। আইরিশ এল্কের এক একটি শিং লম্বায় হতো ১২ ফুট আর ওজনে হতো ৪০ কেজিরও ওপরে। এদের ঘাড়ই হতো ৭ ফুট চওড়া। তবেই বোঝো, পুরোটা মিলিয়ে কি বিশালই না ছিলো এল্ক হরিণ!


প্লয়োস্টোসিন যুগের শেষ ভাগ থেকে হলোসিন যুগের শুরু পর্যন্ত টিকে থাকা বিশাল আকারের এল্ক হরিণ ঠিক কীভাবে বিলুপ্ত হয়েছিলো, তার কারণ আজও পুরোপুরি ধরতে পারেননি গবেষকেরা। অনেকের ধারণা প্রাগৈতিহাকি মানুষের শিকারে পরিণত হয়ে হারিয়ে গেছে এই হরিণের প্রজাতিটি। আবার অনেকেই মনে করেন বিশাল আকারের কারণেই প্রকৃতিতে সহজভাবে খাপ খাইয়ে নিতে না পারায় বিলুপ্তির পথে হেঁটেছে আইরিশ এল্করা।

যেভাবেই হোক, আইরিশ এল্ক এর সবচেয়ে কমবয়সী ফসিলটি সাত হাজার সাত শ’ বছরের পুরোনো, তা থেকেই ধারণা করা হয় খৃষ্টপূর্ব ৫৭০০ সাল থেকেই এই প্রাণীটি নাম লেখায় বিলুপ্তির খাতায়।

ডোডোর জন্য শোকগাঁথা
মরিশাস দ্বীপের ডোডো পাখিদের গড়তে গিয়ে ঈশ্বর মনে হয় একটু ভুলই করে ফেলেছিলেন; বেচারাদের পাখি হিসেবে তৈরী করলেও উড়বার উপযুক্ত ডানাজোড়া আর দেননি তিনি। আর নিষ্ঠুর মানুষও এর সুযোগ নিতে একটুও পিছপা হয়নি; উড়তে অক্ষম অসহায় এই পাখিদেরকে তারা শিকার করেছে নির্বিচারে। আর তাই আজ আর দেখা যায় না ডোডো পাখিদের। মানুষের নিষ্ঠুরতাকে সাক্ষী রেখে সেই ১৭ শতকেই পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছে এই প্রজাতিটি।

তিন ফুট উচ্চতার কবুতর গোত্রীয় এই পাখিদের বিলুপ্তিতে মানুষের অবদান এতোটাই যে এটি নিয়ে প্রচলিত আছে অনেক প্রবাদও। ইংরেজিতে প্রবাদ আছে ‘টু গো দ্যা ওয়ে অফ দ্যা ডোডো’। এর মানে হচ্ছে বিলুপ্তির বা ধ্বংসের পথে যাওয়া; ডোডোদের বিলুপ্তির ইতিহাসকে স্মরণে রেখেই যা প্রচলিত হয়েছে। ডোডোদের নিয়ে আরেকটি প্রবাদ হলো ‘অ্যাজ ডেড অ্যাজ ডোডো’। এর মানে নিশ্চিতভাবেই মৃত। এটাও নির্দেশ করে প্রজাতিটির পুরোপুরি বিলোপের ইতিহাসকে।
সোনালি ব্যঙ এর গল্প
মানুষকে বলা হয় পৃথিবীর সবচেয়ে বুদ্ধিমান প্রাণী। কিন্তু যে মানুষ তার সবচেয়ে উপকারী বন্ধু সবুজ প্রকৃতিকে ধ্বংস করে বিপদের মুখে ঠেলে দিচ্ছে এই পুরো পৃথিবীকেই, তাকে কি তোমরা বুদ্ধিমান বলবে? আমাদের বন্ধু সবুজ সুন্দর গাছেদের কেটে কেটে আমরা নিজেরাই যে নিজেদের ক্ষতি করছি, পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধি, অকাল খরা, ভয়ংকর বন্যা-ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ¡াস আর দূষিত পরিবেশ জানান দিচ্ছে সেটাই। শুধু তাই নয়, এই সবুজ পরিবেশে আমাদের পাশাপাশি যে সব প্রাণীরা বসবাস করে, তাদের অস্তিত্বকেও আমরা ফেলছি হুমকির মুখে। আর এমনি ভাবেই হারিয়ে গেছে সোনালি রংয়ের অসম্ভব সুন্দর একটি ব্যাঙ।

কোস্টারিকার এই সোনালি ব্যাঙ বা গোল্ডেন টোডের দেখা গত শতকের আশির দশকেও পাওয়া যেতো। কিন্তু ১৯৮৯ সালের পর থেকেই হারিয়ে যায় বিরল প্রজাতির এই উজ্জ্বল কমলাটে সোনালি রঙের ব্যাঙ।

একে প্রথম খুঁজে বের করেন উভচরবিদ জে স্যাভেজ, ১৯৬৬ সালে। দক্ষিণ আমেরিকার কোস্টারিকা নামের দেশটির মন্টে ভার্দে নামের একটি জায়গাকে ঘিরে রাখা বিশাল অরণ্যে ছিলো এদের বাস। ১৯৮৭ সাল পর্যন্তও এদের বংশবৃদ্ধি স্বাভাবিকভাবেই হতো; কিন্তু সে বছরের আবহাওয়া এতোই খারাপ ছিলো, পুরো কোস্টারিকা জুড়েই দেখা দেয় খরা। আর সে খরাতেই ব্যঙগুলোর লার্ভা (ব্যাঙের বাচ্চা অবস্থা) যে সব জলাশয়ে জন্ম নিতো, সেগুলো শুকিয়ে যায়। মারা যায় হাজার হাজার সোনালি ব্যাঙ এবং তাদের লার্ভা। ৩০ হাজারের মধ্য থেকে শেষ পর্যন্ত বেঁচে থাকে কেবল ২৯ টি ব্যাঙ।

তার পরের বছর এই সংখ্যা কমে দাড়ায় দশটিতে। আটটি পুরুষ এবং দুটি মেয়ে সোনালী ব্যাঙ এর এই ক্ষুদে দলটিও শেপর্যন্ত টিকে থাকতে পারেনি; বৈরি প্রকৃতি থেকে তারাও বিদায় নেয় খুব দ্রুতই। ১৯৮৯ সালে এই প্রজাতির শেষ ব্যাঙটিও মারা যায়।

এমনিভাবে এক এক করে হাজার হাজার প্রজাতির প্রাণী হারিয়ে গেছে পৃথিবী থেকে। পৃথিবীর স্বাভাবিক নিয়মেই হারিয়ে গেছে অনেক প্রাণী; প্রকৃতির নিয়মই হলো পৃথিবীর আবহাওয়া আর জলবায়ুর বদলের সাথে সাথে প্রাণীরাও বদলে যাবে। আর যে সব প্রাণী বদলে যেতে পারে না, তারা হারিয়ে যায়, বিলুপ্ত হয়ে যায়। কিন্তু মানুষ বড়ো দ্রুতই বদলে দিচ্ছে পৃথিবীকে। এতো দ্রুত, যে প্রকৃতি নিজেও তাল মিলাতে পারছে না। আর তাই খুব দ্রুত পৃথিবী থেকে হারিয়ে যাচ্ছে হাজারো প্রাণী। আর অনেক প্রাণীকে তো মানুষ কেবল লোভে পড়েই মেরে ফেলছে। এই যেমন উপরের কাগা আর ডোডো পাখি। অথচ কাগা’রা থাকলে কত্তো মজা হতো। বাড়ির পাশের চিড়িয়াখানায় গিয়ে কিংবা ছবিতে স্বপ্নের মতো এই অর্ধেক ঘোড়া আর অর্ধেক জেব্রাদের দেখতে পারলে কেমন মজা হতো চিন্তা করো? এমনি এমনিই তো আর সুকুমার রায় হাঁসজারু আর বকচ্ছপদের কথা বলেননি! এখন কিন্তু আমাদের আরো বেশি সচেতন হতে হবে। নইলে আমাদের দেশের হাজারো প্রাণী তো হারিয়ে গেছেই, যে কয়টা আছে, তারাও যদি হারিয়ে যায়, তখন কি হবে? যদি আর না থাকে রয়েল বেঙ্গল টাইগার কিংবা প্যারাহরিণ? লম্বা নাকের ঘড়িয়াল যদি হারিয়ে যায়? আর কাঠবেড়ালি? তখন নজরুলের ঐ কাবিতাটাই তো মাঠে মারা যাবে। ঐ যে, ‘কাঠবেড়ালি, কাঠবেড়ালি, পেয়ারা তুমি খাও?’

Blogger templates

.
Recommended Post Slide Out For Blogger