মশা কাহিনী

|

মশার জন্ম
মশারা কিভাবে বংশবিস্তার করে জানো? মা মশারা ডিম পাড়ে, আর সেই ডিম ফুটে তবেই মশা হয়। আর মা মশা কিন্তু একবারে একটা-দুটো ডিম পাড়ে না, অনেকগুলো ডিম পাড়ে। আর কোথায় ডিম পাড়ে জানো? নোংরা আর বদ্ধ দেখে কোনো ডোবা বা পুকুরে! ভাবছে, তবেই তো ডিমগুলোর ডুবে যাবার কথা! না, ডোবে না। কারণ, মা মশা ডিমগুলোকে একসাথে করে একটা ভেলার মতো বানিয়ে পুকুরে ছেড়ে দেয়। অনেকটা লাল পিঁপড়াদের ভেলার মতো। আর তাই ডিমগুলো তো ডোবেই না, উল্টো সুন্দর লাইন করে মার্চ করা সৈন্যদের মতো ভাসতে থাকে।


সমস্যা কিন্তু তারপরও রয়ে গেলো। কি সমস্যা? আরে, মশার ডিম তো সাদা। এখন একসঙ্গে এতোগুলো সাদা ডিম ভাসতে থাকলে পাখি আর পোকা-মাকড়দের চোখে পড়ে যাবে না ওগুলো! তখন তো ওরা এসে মজা করে খেয়ে নিবে, আর আমাদেরকেও মশার কামড় খেয়ে খেয়ে হাত-পা ফুলোতে হবে না। কিন্তু আমাদের ভাগ্য আবার এতো ভালো না। মশার ডিমগুলো যাতে পাখি আর পোকা-মাকড়দের চোখে না পড়ে, তার জন্য ডিমগুলোতে থাকে এক বিশেষ ব্যবস্থা। পানিতে মশার ডিমের ভেলা ভাসতে না ভাসতেই ওগুলোর রং কালো হতে থাকে। আর কালো হয়ে গেলে তো ওগুলোকে আর ওভাবে দেখাই যায় না। আগেই তো বললাম, মা মশা নোংরা দেখে পুকুরে কি ডোবায় ডিমের ভেলা ভাসায়!

লার্ভার বাদুড়-ঝোলা!
এইবার মশাদের জন্ম নেয়ার অভিযানের শুরু। কিছুদিনের মধ্যেই ডিমগুলোর ভেতরে ছোট্ট ছোট্ট মশারা জন্ম নেয়। না, তক্ষুণি ফুটে বের হয় না। কারণ, ওরা তো তখনো কোনোভাবেই মশা হয়ে ওঠে নি, ডিমের ভেতরে পুঁচকে ক্ষুদে কৃমির মতো লম্বাটে এক ধরনের প্রাণী হয়েছে। এই বাচ্চা মশাদের বলা হয় ‘লার্ভা’। এখন মজা কি জানো? এই লার্ভারা ডিমের ভেতর বাদুড়ের মতো উল্টো হয়ে থাকে! মানে, মাথা থাকে নিচের দিকে। তাহলে বলো তো, ওরা নিঃশ্বাস নেয় কিভাবে? এখানেই তো প্রকৃতির খেলা। লার্ভাগুলোর একটি বিশেষ অঙ্গ থাকে, অনেকটা পানি খাবার স্ট্র-র মতো। সেটার এক মাথা থাকে লার্ভার মুখে, আরেক মাথা থাকে ডিমের বাইরে, পানির উপরে। ব্যস, সমাধান! পানির উপরে বাতাস থেকে লার্ভাগুলো এবার উল্টো হয়ে ঝুলতে ঝুলতে মজাসে নিঃশ্বাস নিতে থাকে।

অনেকের মনেই হয়তো প্রশ্ন জেগেছে, স্ট্র’টা দিয়ে না হয় ওরা নিঃশ্বাস নিলোই, কিন্তু ঢেউয়ের তোড়ে যদি স্ট্রয়ের ভেতর পানি ঢুকে যায়, তখন? এটারও ব্যবস্থা আছে। স্ট্রয়ের মুখে এক ধরনের আঠালো পদার্থ থাকে, ওটার জন্য স্ট্র দিয়ে কেবল পানি ঢুকতেই পারে, বেরোতে আর পারে না! অনেকটা বিজ্ঞান বইয়ের একমুখী ভাল্বের মতোই।

এমনি নিরাপদে ডিমের ভেতর বড়ো হতে থাকে লার্ভাগুলো। এগুলো আস্তে আস্তে কৃমির মতো চেহারা থেকে মশার মতো চেহারা নিতে থাকে। ওটার রক্ত খাওয়ার হুল, মুখ, পা, পাখা, চোখ সব গজাতে থাকে। কিন্তু হলে কি হবে, ও তো এখনো ডিমের ভেতরেই আছে! আগে তো ওকে ডিম থেকে বের হতে হবে,তারপর না আমাদের গায়ে হুল ফুটিয়ে রক্ত বের করবে!

ডিম ভেঙে পানিতে!
বাচ্চা মশার ডিম থেকে বের হওয়ারও কিন্তু বেশ একটা মজা আছে। বাচ্চা মশা বের হওয়ার সময় ডিমটা ভাঙ্গে মাথার দিক থেকে। মনে আছে নিশ্চয়ই, ডিমের ভেতর ওরা উল্টো হয়ে থাকে! মানে মাথা থাকে নিচের দিকে। এখন ডিমটা ভাঙলো, আর অমনি হুড়মুড় করে পানি ঢুকে গেলো, তাহলেই তো আর দেখতে হতো না। ডিম ফুটতে না ফুটতেই পানি ঢুকে বাচ্চা মশাটা পানিতে দম বন্ধ হয়ে মারা যেতো। এটারও একটা ব্যবস্থা আছে। ডিমের মাথার দিকটাতেও পানিরোধী এক ধরনের আঠালো জিনিস থাকে, ওটার জন্য ডিম ভাঙলেও পানি আর ঢুকতে পারে না। আর পুরো ডিমটা ভাঙলে পরে মশার বাচ্চাও বের হয়ে কোমরে হাত দিয়ে নায়কের মতো পানির উপরে দাঁড়িয়ে পড়ে!

ভাবছো, বোধ হয় আমার মাথাটাই খারাপ হয়ে গেছে। তাই মশার গল্প বলতে বলতে গুল মারতে শুরু করে দিয়েছি। নয়তো, মশারা আবার কখনো পানির উপর দাঁড়াতে পারে নাকি! তাও আবার মাত্র ডিম ফুটে বের হওয়া ফুটফুটে মশার বাচ্চা। হ্যাঁ, ওরা তা পারেও বইকি! কারণ, ওদের পায়ে এক বিশেষ ধরনের জিনিস থাকে, সেটার জন্য ওরা পানির উপর দাঁড়িয়ে থাকতে পারে। কিন্তু সেই সময়টা কিন্তু ওদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, ওদেরকে পানির উপর সুন্দর করে দাঁড়িয়ে ওড়ার প্রস্তুতি নিতে হয়। তারপর টুক করে উড়ে যেতে হয়। কিন্তু কোনোভাবে যদি ওড়ার আগেই পানিতে ওদের পাখা ভিজে যায়, তবেই সেরেছে। তখন তো আর উড়তে পারবে না। আর পাখা ভিজে ভারি হয়ে গেলে তো বাচ্চাটা ব্যালেন্সও রাখতে পারবে না, পানিতেই পড়ে যাবে। আর ওরা তো আর ব্যাঙের বাচ্চা না, যে পানিতে ইচ্ছেমতো সাঁতরে বেড়াবে। পানিতে পড়লেই ওরা টুপ করে ডুবে যাবে। তাই এই সময়টাতে ওদেরকে খুবই সতর্ক থাকতে হয়। আর আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, ওরা কিন্তু এই চরম কঠিন কাজটাও জন্মের পরপরই খুবই পারদর্শিতার সাথেই করতে পারে।

মশার অনুসারী মানুষ!
কি বিশ্বাস হচ্ছে না? ভাবছো, মানুষ নিজেই কত্তো বুদ্ধিমান, মানুষ আবার ওদের অনুসরণ করতে যাবে কেন? আরে, বুদ্ধিমান বলেই না অনুসরণ করে। মশার একটা অদ্ভ‚ত গুণ আছে। কখনো খেয়াল করেছো, রাতের বেলা ঘরের বাতিটা নিভিয়ে দেওয়ার পর ঘুটঘুটে অন্ধকারেও মশারা কি মজা করে তোমাকে খুঁজে বের করে তোমার শরীরে হুল ফুটিয়ে চোঁ চোঁ করে রক্ত খেতে থাকে! শুধু তাই না, তুমি হয়তো সারা শরীর ঢেকেঢুকে ঘুমিয়ে আছো, তারপরও তোমার হাতের অল্প একটু বের হয়ে আছে। ব্যস, মশাদের তাতেই চলবে। তোমার ঐ হাতের অংশটা খুঁজে বের করে হুল ফুটিয়ে দেবে। কিন্তু কিভাবে ওরা অন্ধকারে এমন দেখতে পায়?

আসলে, সব জীবন্ত প্রাণীদের শরীর থেকেই এক ধরনের তাপ বের হয়। আলো কিন্তু আসলে তাপেরই একটা রূপ। তোমার বাসার বাতিটার কাছে হাত নিয়ে দেখো, গরম লাগবে। আর বাতি নেভার পরপরই হাত দিলে দেখবে, বাতিটা রীতিমতো গরম হয়ে আছে, বেশিক্ষণ ধরেও রাখতে পারবে না। তাপ আর আলোর এই সম্পর্কটা বোঝার জন্য সবচেয়ে ভালো উদাহরণ হলো আগুন। এবার তো মনে হয় ধরে ফেলেছো ব্যাপারটা। আর জীবন্ত প্রাণীদের শরীর থেকে যে তাপটা বের হয়, সেটা আমরা মানুষরা দেখতেই পাই না। শুধু মানুষকে দোষ দিয়ে লাভ কী, বেশিরভাগ প্রাণীই ওটা দেখতে পায় না। কিন্তু মশারা আবার ওটা দেখতে পায়। আর তাই তো দেখো না, অন্ধকারে যেনো ওরা আরো আয়েশ করে কামড়াতে পারে। কারণ, তখন তো ওরা তোমাকে ঠিকই দেখছে, কিন্তু তুমি তো আর ওদেরকে দেখতে পারছো না!

ভাবছো, মশাদের না হয় এরকম একটা অনন্য গুণ আছেই, কিন্তু সেটাকে মানুষ অনুসরণ আবার কিভাবে করলো? আরে, নাইট ভিশন গগলস আছে না? ওটা কিভাবে কাজ করে? হ্যাঁ, ওটা-ও এই তাপের আলোকে শনাক্ত করেই কাজ করে।

রক্তচোষার রক্ত চোষা!
মশারা কেন রক্ত চুষে খায়, সে তো আগেই বলেছি। কিন্তু ওরা কিভাবে রক্ত খায় সেটা জানো? অনেকেরই হয়তো ধারণা, ওরা ওদের সিরিঞ্জের মতো হুল ফুটিয়ে দিয়ে রক্ত চুষে নেয়। অনেকটা ঠিকই বলেছো, কিন্তু ওদের রক্ত খাওয়ার প্রক্রিয়াটা এতোটাও সহজ না। দাঁড়াও, বলছি।

ওরা কিভাবে দেখে সেটা তো আগেই বলেছি। এভাবে দেখে দেখে প্রথমে ওরা টার্গেট ঠিক করে। ধরো, একটা মশা একজন মানুষের হাতকে টার্গেট করলো। এবার সেখানে বসে ও আশপাশটা দেখে ঠিক করে, কোথায় হুল ফোটাবে। ঠিক করার পর, উঁহু, আগেই হুল ফুটায় না। আগে ওর নিচের চোয়াল দিয়ে ঘষে ঘষে ওখানকার চামড়াটা কেটে ফেলে। অনেকটা করাত দিয়ে কাটার মতো। এরপর ওখান দিয়ে হুল ঢুকিয়ে দিয়ে রক্তনালী, মানে ধমনী-শিরা-উপশিরা খুঁজতে থাকে। আর কোনো রক্তনালী পেয়ে গেলে তো হয়েই গেলো, কেল্লা ফতে! এবার সিরিঞ্জের মতো হুলটা দিয়ে চোঁ চোঁ করে রক্ত চুষতে থাকে।
রক্তচোষার ডাক্তারি!
রক্তচোষা মশা আবার ডাক্তারি পারে নাকি? পারে পারে, নইলে কি আর ও আমাদের রক্ত এমনি মজা করে চোঁ চোঁ করে সিরিঞ্জে ভরতে পারতো নাকি? আচ্ছা, একটা জিনিস খেয়াল করেছো, তোমার হাত কেটে গেলে কিছু না করলেও একটু পরে এমনিই রক্ত বের হওয়া বন্ধ হয়ে যায়? কারণ, আমাদের রক্তে একটা পদার্থ আছে, যেটাকে বলা হয় অণুচক্রিকা। এই অণুচক্রিকা রক্তকে জমাট বাঁধতে সাহায্য করে। আর তাই আমাদের শরীরের কোথাও কেটে গেলে এটা আমাদের রক্তকে জমাট বাঁধিয়ে ফেলে। তখন আর রক্ত বের হয় না। এবার নিশ্চয়ই মশাদের ডাক্তারিটা কোথায়, তা ধরতে পেরেছো?

হ্যাঁ, মশারা যখন আমাদের চামড়া কেটে সিরিঞ্জের মতো হুলটা ঢুকিয়ে দিয়ে চোঁ চোঁ করে রক্ত টানতে থাকে, ততোক্ষণে অণুচক্রিকা রক্ত জমাট বাঁধাতে শুরু করে। কিন্তু তাহলে তো মশারা নির্বংশই হয়ে যাবে। রক্ত না নিতে পারলে তো ওরা আর ওদের ডিমগুলোকে বাঁচাতে পারবে না। আর ডিম ধ্বংস হয়ে গেলে ওদের বাচ্চা হবে কি করে, আর ওদের বংশ রক্ষাই বা হবে কি করে? কাজে কাজেই, মশাদের ডাক্তারি করতেই হয়। ওরা রক্ত নিতে শুরু করার আগে এমন একটা তরল পদার্থ ওখানকার রক্তে মিশিয়ে দেয়, যেটা রক্তকে আর জমাট বাঁধতে দেয় না। অনেকটা যেনো, তরলটা এসে অণুচক্রিকাকে মেরেকেটে ভাগিয়ে দেয় আরকি! তারপর আর কী, মশাটা মজাসে সিরিঞ্জ ভরে ডিমের জন্য রক্ত নিতে থাকে।

তবে মশাদের এই ডাক্তারি তরলটার কিন্তু আরো একটা গুণ আছে। হাসপাতালে ডাক্তাররা কোনো অপারেশন করার আগে কি করে বলো তো? ওষুধ দিয়ে রোগীকে বা রোগীর যেই অঙ্গে অপারেশন করা হবে, সেই অঙ্গটাকে অবশ করে দেয়। এই তরলটাও সেই একই কাজ করে। মশা তোমাকে কামড়ানোর আগেই রক্তে এই তরলটা মিশিয়ে দেয়। আর তাই মশা যতোক্ষণ মজাসে তোমার শরীর থেকে রক্ত টেনে নিতে থাকে, ততোক্ষণ তুমি কিছুই টের পাও না। আর যখন টের পাও, তখন আর কিছুই করার থাকে না। মশাটা তোমার শরীর থেকে রক্ত খেয়ে-টেয়ে বাক্স-প্যাঁটরা গুছিয়ে উড়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে! তাহলে এবার তুমি-ই বলো, মশাদের যদি ডাক্তার না বলি, তাহলে তো ডাক্তার শব্দটার মানেই পাল্টে ফেলতে হবে!

কী, বলেছিলাম না, মশা মানেই অদ্ভ‚ত আর রোমাঞ্চকর সব গল্প? বিশ্বাস হলো এবার! এবার তুমিই চিন্তা করো, মশাকে তোমার রক্ত খেতে দিবে কি না? তোমার চোখের সামনে এইটুকু ছোট্ট একটা প্রাণী তার করাতের মতো চোয়াল দিয়ে ঘষে ঘষে তোমার চামড়া কেটে ফেলবে, আর তাই যদি তুমি নিজেই সহ্য করো, তাহলে তো আর আমার কিছু বলার নেই। তবে আমি কিন্তু অতো বোকা নই। আমার হাতে মশা বসলে কিন্তু আমি ঠিকই ওকে তাড়িয়ে দেই। আর সবচেয়ে ভালো হলো ঘরে কয়েল জ্বালিয়ে রাখা কিংবা মশার স্প্রে ব্যবহার করা। আর ঘুমানোর সময় মশারি তো অবশ্যই ব্যবহার করতে হবে। কারণ, ঐ যে বললাম না, তুমি অন্ধকারে না দেখলে কি হবে, ওরা কিন্তু ঠিকই দেখে!

Blogger templates

.
Recommended Post Slide Out For Blogger