রহস্যের দ্বীপ মাদাগাস্কার

|
পৃথিবীর অনেক দেশের নামই তো তোমরা শুনেছো, আর অনেক দেশের কথাই তোমরা জানো। কিন্তু ‘মাদাগাস্কার’ দেশটির নাম কি কখনও শুনেছো? অনেকেই হয়তো শুনেছো। কেনো, ‘মাদাগাস্কার’ ছবিটা তোমরা দেখোনি বুঝি? ‘কী দেখবে’ তে তো এই ছবিটার গল্পও পড়েছো। ছবিটার গল্প পড়তে চাইলে কী দেখবে’ তে গিয়ে পড়ে নিও, এখন বরং তোমাদেরকে পরিচয় করিয়ে দিই ‘মাদাগাস্কার’ দেশটির সাথে।

আগে মাদাগাস্কারের নাম ছিলো মালাগাছি। কিন্তু আগের সেই নাম অনেক আগেই বাতিল হয়ে গেছে। এখন এর পুরো নাম ‘দ্য রিপাবলিক অফ মাদাগাস্কার’।  জীববৈচিত্র্যে ভরপুর এ দেশটি পৃথিবীর ৫টি মহাসাগরের একটি ভারত মহাসাগরের পাশে, আফ্রিকার দক্ষিণ-পূর্ব উপকূলে অবস্থিত একটি দ্বীপরাষ্ট্র। তবে ভারত মহাসাগরে অবস্থিত বলেই যেন ভেবে বসো না দেশটি আমাদের আশেপাশেই কোথাও। দেশটি কিন্তু আফ্রিকা মহাদেশের মধ্যে পড়েছে। ৫,৮৭,০০০ বর্গকিলোমিটারের এ দেশটির অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এটি পৃথিবীর চতুর্থ বৃহত্তম দ্বীপরাষ্ট্র। এরচেয়েও বড়ো দ্বীপরাষ্ট্র তিনটি হলো গ্রিনল্যান্ড, নিউ গায়ানা আর বোর্নিও।


তবে মাদাগাস্কার সবচেয়ে বেশি বিখ্যাত কেন জানো? এর অসাধারণ আর অদ্ভূতুড়ে জীববৈচিত্র্যের কারণে। অসংখ্য প্রাণী আর উদ্ভিদে ভরপুর এ দ্বীপটির জীববৈচিত্র্যের কথা শুনলে তুমি সত্যিই অবাক হয়ে যাবে। আর আরো বেশি অবাক হবে এটা শুনলে যে, মাদাগাস্কারের জীবজন্তুগুলোর ৮০ ভাগই পৃথিবীর আর কোথাও পাওয়া যায় না। অর্থাৎ কিনা এসব জীব দেখতে হলে তোমাকে ঐ মাদাগাস্কারেই যেতে হবে। আর এরকম হওয়ার কারণ হচ্ছে দেশটির ভৌগোলিক বৈচিত্র্য। কেমন সেই বৈচিত্র্য? দেশটির পূর্ব এবং মধ্য-দক্ষিণে আছে রেইন ফরেস্ট। আবার পশ্চিমে আছে ড্রাই ফরেস্ট। আবার একই দ্বীপে দুই বনের পাশে দক্ষিণদিকেই আছে মরুভূমি! তবেই বলো, এমন দ্বীপ আর আছে কোথাও? আর এই দ্বীপে যেসব প্রাণীরা থাকে, তারা আর কোন দ্বীপেই বা গিয়ে থাকতে পারবে?

মাদাগাস্কারে প্রায় ৬০০ প্রজাতির জীব আছে। জীব বলতে আবার শুধু পশু-পাখি আর পোকামাকড় আর মাছ ভেবো না। জীব বলতে কিন্তু গাছপালাকেও বোঝায়। ওদেরও তো জীবন আছে! আর যার জীবন আছে, সে-ই তো জীব, তাই না? তো এই দ্বীপের ৬০০ প্রজাতির জীবের মধ্যে নানারকম গাছপালা আছে ৩৮৫ প্রজাতির, কীটপতঙ্গ আছে ৪২ প্রজাতির, মাছ আছে ১৭ প্রজাতির, উভচর প্রাণী আছে ৬৯ প্রজাতির, সরীসৃপ আছে ৬১ প্রজাতির আর স্তন্যপায়ী প্রাণী আছে ৪১ প্রজাতির। ভাবছো, এই উভচর আর সরীসৃপ আর স্তন্যপায়ী আবার কী? যারা যেমন স্থলে থাকে তেমনি আবার জলেও থাকতে পারে, তাদের বলে উভচর প্রাণী। যেমন ধরো ব্যাঙ। সরীসৃপ হলো যারা বুকে ভর দিয়ে চলে। এদের পা থাকেই না। যেমন সাপ, কুমির, কচ্ছপ, তারপর কেঁচো। আর যে সব প্রাণী ডিম দেয় না, মায়ের পেট থেকেই জন্ম নেয়, আর জন্মানোর পর মায়ের দুধ খায়, তাদের বলে স্তন্যপায়ী প্রাণী। আমরা মানুষরাও কিন্তু স্তন্যপায়ী প্রাণী। আবার আমরা যে গরুর দুধ খাই, সেই গরুও স্তন্যপায়ী।


 বিজ্ঞানীদের হিসাবমতে, মাদাগাস্কারে বিভিন্ন প্রজাতির প্রায় ২ লক্ষ প্রাণী এবং গাছ আছে, যার মধ্যে প্রায় দেড় লক্ষ প্রজাতিই পৃথিবীর অন্য কোথাও পাওয়া যায় না। এদের মধ্যে রয়েছে প্রায় ১৫ প্রজাতির লেমুর, ৩৬ প্রজাতির পাখি এবং আরো অনেক অদ্ভূত অদ্ভূত সব প্রাণী। আবার মাদাগাস্কারের অসংখ্য ব্যাঙের মধ্যে শতকরা ৯৫ ভাগই শুধু মাদাগাস্কারেই পাওয়া যায়। তবে অন্য কোথাও খুঁজে পাওয়া না গেলেও এসব প্রাণীদের কিছু কিছু জাত ভাই অবশ্য দক্ষিণ আমেরিকা আর দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে পাওয়া যায়। 
সরীসৃপ : যতো বিষহীন সাপ আর ভয়ঙ্কর কুমির

সরীসৃপ প্রাণী কাদেরকে বলা হয় তা তো তোমাদেরকে আগেই বলেছি। মাদাগাস্কার প্রায় ৩০০ প্রজাতির সরীসৃপের আবাসস্থল। মাদাগাস্কারে প্রায় সব ধরনেরই সরীসৃপই থাকে। কেননা, পৃথিবীর প্রায় ৯০% সরীসৃপই শুধুই মাদাগাস্কারে থাকে। বলতে পারো, মাদাগাস্কার সরীসৃপদের স্বর্গ আরকি! এদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে গিরগিটি, সাপ, কুমির ইত্যাদি। তবে দুর্লভ হলেও এদের সবগুলোই যে পৃথিবীর আর কোথাও দেখতে পাওয়া যায় না তা কিন্তু নয়। এই যেমন ধরো অজগর সাপের কথাই। মাদাগাস্কার ছাড়াও আফ্রিকা এবং এশিয়ার বিভিন্ন জায়গায়, এমনকি আমাদের বাংলাদেশেও তুমি এই বিশাল সাপ দেখতে পাবে। তবে শখ করে কখনো কিন্তু একা একা অজগর সাপ দেখতে জঙ্গলে যেয়ো না। কেননা ক্ষূধার্ত অজগর খুবই ভয়ংকর হয়। এরা এদের শরীর দিয়ে পেঁচিয়ে ধরে শিকারকে মেরে ফেলে আর তারপর তা ধীরে সুস্থে একদম আস্তই গিলে ফেলে। কী ভয়ানক ব্যাপার, চিন্তা করো! যাই হোক, অজগর ছাড়াও আছে ‘ইগুনাইড গিরগিটি’ আর ‘বোয়া’(অজগরের মতই এক ধরনের বিশালাকৃতির সাপ)। এদেরকে আবার মাদাগাস্কার ছাড়াও দক্ষিণ আমেরিকায়, বিশেষ করে মহাবন আমাজনে বেশি দেখতে পাওয়া যায়।



কচ্ছপ কচ্ছপ!
কচ্ছপ তোমাদের কেমন লাগে বলো তো? অলস প্রকৃতির এই প্রাণীটিকে তো নিশ্চয়ই ভালো লাগে। আর শক্ত খোলসের ভেতরে বসবাসকারী এ প্রাণীটি কিন্তু সত্যিই বেশ অদ্ভুত আর মজার। মাদাগাস্কারে এই কচ্ছপ আছে প্রায় ৪ প্রজাতির। এদের মধ্যে সবচেয়ে পরিচিত আর বড় আকারের কচ্ছপটির নাম হচ্ছে ‘প্লোশেয়ার কচ্ছপ’। এরা কিন্তু দুর্লভ প্রজাতির। আর আশঙ্কার কথা কি জানো? মাদাগাস্কারের কচ্ছপের সবগুলো প্রজাতিই বিলুপ্তপ্রায়।


মাদাগাস্কারের যতো সাপ!
এবার আসা যাক মাদাগাস্কারের সাপেদের কথায়। কী, সাপের কথা শুনে আবার ভয় পেয়ে গেলে নাকি? অবশ্য ভয় পাওয়ারই কথা। সাপের নাম শুনলেই তো অনেকের গা শিরশির করে ওঠে, এমনকি আমার নিজেরও! কী অদ্ভূত প্রাণীরে বাবা! হাত নাই, পা নাই, গলা নাই, কেমন হিচড়ে হিচড়ে গড়িয়ে গড়িয়ে চলাফেরা করে! দেখলেই তো গা কেমন গুলিয়ে ওঠে! তবে অনেক সাপ কিন্তু এত্তো সুন্দর, যে দেখলে চোখ ফেরানো যায় না। যাই হোক, মাদাগাস্কারে সাপ আছে মোট ৮০ প্রজাতির। তবে এদের কোনোটাই বিষাক্ত তো নয়ই, ভয়ংকরও না। আসলে যে প্রজাতির সাপগুলো বিষাক্ত হয়, এই যেমন ধরো গোখরো, মাম্বা, ভাইপার, র‌্যাটল স্নেক, এসব সাপ মাদাগাস্কারে থাকেই না। বোয়া আর ক্লুব্রিডস সাপই এখানে বেশি পাওয়া যায়। একমাত্র বিষাক্ত সাপটির নাম হচ্ছে ‘রেয়ার-ফেংড’। যদিও এই সাপ কামড় দিলে মানুষ মারা যায় না, বড়জোর শরীরের কিছু অংশ একটু অবশ হয়ে যায়। সে আর এমন কী! আমাদের গোখরো এক কামড় দিলেই তো নির্ঘাত মরণ। তবে সমুদ্রে দু’ধরনের খুব বিষাক্ত সাপ আছে। এদের একটির নাম হচ্ছে ‘হুক-নোজড সি স্নেক’ আর অন্যটি হচ্ছে ‘ইয়েলো-বেলিড সি স্নেক’।

কুমির কান্ড
এবার আসি কুমিরের কথায়। ছোটবেলায় কুমির আর শিয়ালের গল্প তো নিশ্চয়ই শুনেছো। হ্যাঁ, সেই কুমিরের কথাই বলছি। ‘নাইল ক্রোকোডাইল’ নামে এর ধরনের কুমির পাওয়া যায় মাদাগাস্কারে, যদিও খুব একটা বেশি না। আগে এই কুমির প্রচুর পরিমাণে দেখা যেত,আর মানুষ এই কুমির খুব ভয়ও পেত। কিন্তু মানুষ যখন থেকে চামড়ার লোভে এই কুমির শিকার করা শুরু করলো তখন থেকেই এদের সংখ্যা ধীরে ধীরে কমতে শুরু করলো। এখন তো এরা বলতে গেলে বিলুপ্তপ্রায়।  তবে আশার কথা হচ্ছে, গবেষকরা তাদের গবেষণার কাজের জন্য এসব কুমির সংরক্ষণ করা শুরু করেছেন। আর মানুষ খায় বলেই যে সব কুমির মেরে শেষ করে ফেলতে হবে, এমন তো কোনো কথা নেই।

এত্তো পাখি এক দ্বীপে!

বন্ধুরা, তোমাদের মধ্যে কি এমন কেউ কি আছো, যে পাখি ভালোবাসো না? আকাশে ডানা মেলে ঘুরে ঘুরে উড়তে থাকা পাখি দেখতে কার না ভালো লাগে বলো? আমাদের দেশের একজন স্বনামধন্য শিক্ষক ড. হুমায়ুন আজাদ কি বলেছিলেন জানো? তার যখন খুব মন খারাপ থাকতো, তখন যদি ঘরের জানালায় কোনো পাখি এসে বসতো, সে পাখি দেখেই তার মন ভালো হয়ে যেতো। তোমাদেরও এরকম হয় কিনা দেখো তো।

পৃথিবীর সব দেশেই পাখি কমবেশি পাওয়া যায়। তবে মাদাগাস্কারে এই পাখি আছে প্রায় ২৫৮ প্রজাতির। দুই-শ-আ-টা-ন্ন প্রজাতির! বুঝতেই পারছো, কত্তো পাখি আছে ঐ এক চিলতে মাদাগাস্কারে! এর মধ্যে আবার ১১৫ প্রজাতি হচ্ছে এন্ডেমিক- অর্থাৎ পৃথিবীতে এদের একমাত্র বাসা মাদাগাস্কার। এমনকি আফ্রিকার অন্য কোনো দেশেও তুমি এদেরকে পাবে না।

একসময় মাদাগাস্কারে বিশালাকৃতির এক ধরনের পাখি দেখা যেত। একেকটা পাখি ওজনে ছিলো প্রায় ৫০০ কেজি আর উচ্চতায় হতো প্রায় ১০ ফুট। বোঝো অবস্থাটা! অর্থাৎ একেকটা পাখি আকারে একেকটা ছোটোখাটো হাতির সমান! ‘এপিওরনিস’ নামের এই পাখিটিকে তাই ডাকা হতো ‘এলিফেন্ট বার্ড’ নামেই। কিন্তু এত বিশালাকার হওয়া সত্ত্বেও মানুষের লোভ থেকে বাঁচতে পারেনি পাখিটি। গত কয়েক শ’ বছর ধরে সব লোভী লোভী শিকারি এই পাখিটিকে এতোই বেশি শিকার করেছে, যে পৃথিবী থেকে একদম বিলুপ্তই হয়ে গেছে এই দানব পাখিটি। তবে মাদাগাস্কারের বিভিন্ন স্থানে এখনও মাঝে মাঝে খুঁজে পাওয়া যায় এই পাখির ডিম। বিজ্ঞানীরা পাখিটি সত্যি সত্যি না দেখলেও ডিমের আকার দেখেই পাখির এহেন বিশাল আকারের কথা অনুমান করেছেন। কেননা, এপিওরনিসের একেকটা ডিমের ওজনই প্রায় ১০ কেজি! আর যদি কোনোভাবে একটা ডিমের ওমলেট করা যায় সেটা দিয়ে তুমি একসঙ্গে দেড়শ’জনকে খাওয়াতে পারবে! তাহলেই বলো পাখিটার আকার কী কোনো দিক দিয়েই হাতির চেয়ে কম হওয়ার কথা!


রাজ্যের যতো কীটপতঙ্গ

অসংখ্য বিচিত্র ধরণের কীটপতঙ্গের আবাসস্থল এই মাদাগাস্কার দ্বীপে। ক্যালিফোর্নিয়ার বিজ্ঞান একাডেমির এক হিসাব অনুযায়ী, মাদাগাস্কারে পাওয়া মাকড়সার প্রায় ৮০% পৃথিবীর আর কোথাও পাওয়া যায় না। মোট ৪১৮ প্রজাতির মাকড়সার মধ্যে ৩৭৯ প্রজাতিই এন্ডেমিক। এন্ডেমিক মানে মনে আছে তো? যাদের আর কোথাও পাওয়া যায় না। আর মাদাগাস্কারে শুধু এই মাকড়সাই আছে কতো প্রজাতির জানো? প্রায় ১০০০ প্রজাতির! বাকি সব কীটপতঙ্গের কথা আজ না হয় নাই-বা বললাম। বুঝতেই তো পারছো, সবগুলোর কথা বলতে গেলে একটা বিশাল বই-ই লিখতে হবে!
সুস্বাদু সব মাছেদের ঝাঁক

মাছ খেতে তো সবাই-ই খুব পছন্দ করো! সুস্বাদু মজাদার সব মাছ খেতে যেমন ভালো লাগে তেমনি এক্যুরিয়ামে ছোট ছোট সুন্দর সুন্দর মাছদের ছোটাছুটি দেখতেও খুব ভালো লাগে,তাই না? মাদাগাস্কারের সমুদ্রেও কিন্তু এমনি সুন্দর সুন্দর প্রচুর মাছ আছে। তবে ওখানকার অনেক মাছই আবার বিলুপ্ত হয়ে গেছে। বাকি মাছগুলোও খুব একটা শান্তিতে নেই। ওদের বেশিরভাগই বিলুপ্ত হওয়ার পথে। আর এর অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে জমিতে কীটনাশকের ব্যবহার। সব্জি আর ধানক্ষেতে ব্যবহার করা এই সব কীটনাশক আর সার বৃষ্টির পানিতে ধুয়ে নদী-নালা আর সাগরের পানিতে মিশছে। আর কীটনাশক তো সত্যি সত্যিই বিষ। সেগুলো খেলে আমাদেরও ক্ষতি হয়, কিন্তু একবারে তেমন বেশি ক্ষতি হয় না বলে আমরা হঠাৎ করে তা টের পাই না। কিন্তু মাছরা তো সে সব খেয়ে একবারে মরেই যাচ্ছে। আর তাই মাদাগাস্কারের শেকহেডস, মস্কুইটো ফিশের মতো অদ্ভূত অদ্ভূত আর সুন্দর সুন্দর সুস্বাদু মাছগুলোর প্রায় সবই এখন বিলুপ্তির পথে।


একমাত্র উভচর প্রাণী- ব্যাঙ

আচ্ছা বলতো, ব্যাঙ কী ধরণের প্রাণী? হ্যাঁ, ব্যাঙ হচ্ছে অ্যাম্ফিবিয়ান মানে উভচর প্রাণী। অর্থাৎ, ব্যাঙ ডাঙায় বাস করে আবার জলে ডিম পাড়ে। আর একটা নির্দিষ্ট বয়স পর্যন্ত ব্যাঙদের বাচ্চারাও কিন্তু পানিতেই থাকে। আমাদের দেশে খুব বেশি প্রজাতির ব্যাঙ দেখতে পাওয়া যায় না। অল্প কয়েক প্রজাতির ব্যাঙের দেখা মেলে। আর শহরে তো ওদের দেখা মেলাই ভার। কারণ ব্যাঙ থাকে অন্ধকার স্যাঁতসেঁতে পরিবেশে, জলাশয়ের আশেপাশে। আর বৃষ্টি হলেই ঘ্যাঙর ঘ্যাঙ করে গলা সাধতে লেগে যায়। মাদাগাস্কারে উভচর প্রাণীদের মধ্যে একমাত্র ব্যাঙই দেখতে পাওয়া যায়। আর মাদাগাস্কারে এই ব্যাঙই আছে প্রায় ৩০০ প্রজাতির! এরচেয়েও মজার ব্যাপার হচ্ছে, এসব প্রজাতির মধ্যে দু’চারটি ছাড়া আর কোনোটাই অন্য কোথাও দেখতে পাওয়া যায় না!

আরো মজার কথা কি জানো, মাদাগাস্কারে অনেকেই নাকি শখ করে ব্যাঙ পোষে! খুব অবাক লাগছে শুনে? আসলে মাদাগাস্কারের ব্যাঙগুলো এতোই সুন্দর যে দেখলেই পুষতে ইচ্ছে করে। এই যেমন ধরো ‘ম্যান্টেলা’ নামের ব্যাঙটির কথা। এটি মাদাগাস্কারের সবচেয়ে জনপ্রিয় পোষা ব্যাঙ। এই ব্যাঙটির চামড়ায় এতোসব বিচিত্র আর উজ্জ্বল রঙের সমাহার যে দেখলে চোখ ফেরানো যায় না। আবার ‘ম্যান্টিডাক্টিলাস’ নামের আরেক ধরনের ব্যাঙ আছে যারা তাদের গায়ের রঙ শুধু যে বিচিত্র তা-ই না, ওরা ওদের গায়ের রং আবার ঘন ঘন পরিবর্তনও করতে পারে! নিশ্চয়ই ভাবছো, এই রঙ পাল্টানোর আবার দরকারটা কী? আসলে শত্রুর হাত থেকে রক্ষা পাবার জন্য এভাবে রঙ পাল্টে ছদ্মবেশ ধরে এই ব্যাঙ। চাইলে একে তোমরা ছদ্মবেশী ব্যাঙও বলতে পারো!


মাদাগাস্কারে আবার অসংখ্য প্রজাতির গেছো ব্যাঙও পাওয়া যায়। এই যেমন ধরো, বুফিস, হেটারিক্সালাস ইত্যাদি। গাছের ডালে ডালে অথবা পাতায় পাতায় ঘুরে বেড়ানোটাই এদের স্বভাব। আরেক ধরনের ছোট ছোট ব্যাঙ আছে যেগুলোকে বলা হয় ‘টমেটো ব্যাঙ’। এরা নিজেদের আত্মরক্ষার জন্য গা থেকে আঠালো এক ধরণের রস ছাড়ে। অন্য কোন প্রাণী এই যেমন ধরো কলুব্রিড সাপ কি কুকুর কি বিড়াল এদের খেয়ে ফেলতে আসলো, অমনি এই রস ছেড়ে পালিয়ে যায় টমেটো ব্যাঙ। যাকে বলে রস দেখিয়ে পালানো! মানুষের জন্যও কিন্তু এই রস খুব ক্ষতিকর। যেখানে লাগে সেখানে প্রচণ্ড চুলকানি হয়।

দু’পায়ের প্রাইমেট- লেমুর

আচ্ছা, লেমুরের সাথে কি তোমাদের কখনো পরিচয় হয়েছে? দেখেছো কখনো? অবশ্য বাংলাদেশে যেখানে সেখানে তুমি লেমুর দেখতেও পাবে না। কেবল চিড়িয়াখানায় গেলে  যদি এদের দেখা মেলে। তাহলে শোনো লেমুরের কাহিনী।

লেমুর দেখতে খানিকটা কুকুর আর খানিকটা কাঠবিড়ালের মতো! অবশ্য বলা যায় এরা অনেকটাই বিড়ালের মতো দেখতে। আবার এদের স্বভাব চরিত্র কিন্তু একদমই বিড়ালের মত নয়। লেমুর আর বিড়ালের স্বভাবে বিস্তর পার্থক্য রয়েছে। এই যেমন ধরো, বিড়াল ডাকে মিঁয়াউ মিঁয়াউ করে। আর লেমুর তিমি মাছের মত একধরনের অদ্ভূত শব্দ করে। লেমুর আবার হাঁটে বানর অথবা গরিলার মতো দু’পায়ে ভর দিয়ে! বেশিরভাগ প্রজাতির লেমুরই সাধারণত নিশাচর হয়, অর্থাৎ রাতের বেলা খাবার খেতে বের হয়। বিড়ালের মতো দুধ বা মাছ খেতে মোটেও পছন্দ করে না এরা। তোমার সঙ্গে মিল পাচ্ছো, তুমিও তো দুধ খেতে একদম পছন্দ করো না। কিন্তু ওরা কি খেতে পছন্দ করে শুনলেই তুমি আর এ কথা বলবে না। ওদের পছন্দের খাবার হচ্ছে পোকামাকড়। কি এরচেয়ে তো দুধ খাওয়াই ভালো, তাই না? আর দেখতে লেমুর সাধারণত ছোট আকারের হয়। তবে এদের নাকটা হয় লম্বা। আর থাকে দু’টো কালো কালো ভূতুড়ে চোখ।



আচ্ছা, প্রাইমেট বর্গের প্রাণীদের তোমরা চেনো তো? না চিনলেও চিন্তার কোন কারণ নেই। চিনিয়ে দিলে খুব সহজেই চিনে নিতে পারবে। যেসব প্রাণীরা দু’পায়ে ভর দিয়ে হাঁটে এই যেমন ধরো মানুষ, বানর, শিম্পাঞ্জী, হনুমান, গরিলা এদেরকে বলা হয় প্রাইমেট বর্গের প্রাণী। মাদাগাস্কারে প্রচুর পরিমাণ প্রাইমেট প্রাণী পাওয়া যায়। এদের পরিমাণ যে কতোটা বেশি তা আন্দাজ করতে পারবে এটা শুনলে যে, পৃথিবীর প্রায় ২১ শতাংশ প্রাইমেটই এই মাদাগাস্কার দ্বীপে বাস করে! তবেই বোঝো! এত্তো বিশাল একটা পৃথিবীর ১০০ ভাগের মধ্যে ২১ ভাগ প্রাইমেটই কিনা বাস করে এই ছোট্ট দ্বীপটিতে। তবে মাদাগাস্কারের এসব প্রাইমেটদের মধ্যে বানর, গরিলা বা শিম্পাঞ্জী খুব একটা নেই। সেখানকার বেশিরভাগ প্রাইমেটই হচ্ছে লেমুর। তাহলে মাদাগাস্কারে যে কি পরিমাণ লেমুর বাস করে তা নিশ্চয়ই আন্দাজ করতে পারছো। আমার তো মনে হয় পুরো দেশজুড়ে শুধু লেমুর আর লেমুর, একদম গিজগিজ করছে।

তবে মাদাগাস্কারে অনেক অনেক বছর আগে লেমুর ছিলো আরও বেশি। এদের মধ্যে ছিলো বুশবেবি, লরিস, পটস, আরো নানান প্রজাতির লেমুর। কিন্তু ক্রমাগত বন কেটে কেটে উজার করার কারণে আর মানুষের লেমুর শিকারের কারণে এদের সংখ্যা এখন অনেকটাই কমে গেছে। তবে মন খারাপ করার কোন কারণ নেই। মাদাগাস্কারে এখনও প্রায় ১৫ প্রজাতির লেমুর পাওয়া যায়। ভাবছো এতো কম প্রজাতি? আসলে সারা পৃথিবীতে লেমুর পাওয়াই যায় মোট ৬৪ প্রজাতির। আর এক মাদাগাস্কারেই যদি ১৫ প্রজাতির লেমুর পাওয়া যায় সে তো নেহায়েত কম নয়।
এদের মধ্যে সবচেয়ে ছোট আকারের লেমুরের নাম হচ্ছে ‘পিগমি মাউস লেমুর’। এদের নামকরণটা একদম যথার্থ। কেননা ‘পিগমি’ হচ্ছে আফ্রিকায় বসবাসকারী একটি উপজাতি, যারা কিনা পৃথিবীর সবচেয়ে খাটো প্রজাতির মানুষ। আর পিগমি মাউস যেমন ছোট, তেমনি ওদের ওজন, মাত্র ২৫ গ্রাম। অর্থাৎ কিনা একটা মাঝারি সাইজের ইঁদুরের সমান। এবার তুমিই বল নামটা যথার্থ হয়েছে কিনা! আর সবচেয়ে বড় আকারের লেমুরের নাম ‘ইন্ড্রি লেমুর’। মাদাগাস্কারের লেমুরগুলোর মধ্যে এখন এই ইন্ড্রি লেমুরই সবচেয়ে বেশি দেখা যায়।

বিজ্ঞানীরা মাদাগাস্কারে বসবাসকারী লেমুরগুলোর প্রায় সব প্রজাতিকেই বিপন্নপ্রায় হিসেবে উল্লেখ করেছেন। যে কোনো সময়-ই এরা বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে। তবে আশার কথা হচ্ছে মাদাগাস্কারে এখনও নতুন নতুন প্রজাতির লেমুর আবিষ্কার হচ্ছে। বিজ্ঞানীরা এটাও বলেছেন যে, পরবর্তী প্রজন্ম নতুন প্রায় ১০-২০ প্রজাতির লেমুরের সন্ধান পাবে! তখন খুব মজা হবে, তাই না? একদম নতুন ধরনের একটা প্রাণী, দেখতেই তো অদ্ভূত রকমের মজা লাগবে!
তো, খুব তো শুনলে মাদাগাস্কারের গল্প, এখন বলো তো দেখি, কেমন লাগলো শুনতে? নিশ্চয়ই ভালো! আসলে নতুন নতুন আর বিচিত্র সব প্রাণীদের গল্প শুনতে কারই না ভালো! আর এতক্ষণ ধরে এসব বিচিত্র প্রাণীদের কথা শুনে তোমাদের মনে এখন কি চিন্তা ঘুরঘুর করছে তা কিন্তু আমি ঠিকই বুঝতে পারছি। আমার মত তোমাদেরও একবার মাদাগাস্কার থেকে ঘুরে আসতে ইচ্ছে হচ্ছে, তাই না? একদম চিন্তা করো না! অপেক্ষা করো, একদিন ঠিকই মাদাগাস্কার যাওয়ার সুযোগ এসে যাবে। আর সেদিন আবার আমাকে সঙ্গে নিতে ভুলোনা যেনো! কিংবা নয়তো ঐ মাদাগাস্কার ছবির মতোই দেখবে কোনদিন পথ ভুল করেই হয়তো মাদাগাস্কারে চলে গেছো। তখন কিন্তু ভয় পেয়ে চিৎকার চেঁচামেচি না করে খুব করে ওখানকার বিচিত্র সব প্রাণীদের মজা করে দেখতে শুরু করে দিও।

Blogger templates

.
Recommended Post Slide Out For Blogger