হারিয়ে যাওয়া ডোডো পাখি

|
ডোডো পাখি- নামটাই কেমন অদ্ভূত, তাই না? এই পাখিটার নামটা যেমন অদ্ভূত, পাখিটা দেখতেও ছিল তেমনই অদ্ভূত। উটপাখির মতো বিশাল আকারের শরীর, সঙ্গে কবুতর কি টিয়াপাখির মতো ছোট্ট একজোড়া ডানা! ভাবছো, এমন অদ্ভূতুড়ে একটা পাখি, পাখিটাকে তো দেখতেই হয়। উহু, তোমার সে আশায় গুড়ে বালি। তুমি চাইলেও পাখিটিকে দেখতে পারবে না। কী করে দেখবে, পাখিটি যে আর পৃথিবীতেই নেই! ১৭০০ সালের আগেই যে ডোডো পাখি পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে!

কীভাবে বিলুপ্ত হলো এই ডোডো পাখি? সে তো বলবোই। তার আগে চলো এই অদ্ভূত আকৃতির পাখিটির গল্প আরো ভালো করে শুনে আসি; কীভাবে পাখিটিকে মানুষ আবিষ্কার করলো, পাখিটি দেখতে-আকার-আকৃতিতে কেমন ছিল, কিংবা ওদের স্বভাব-চরিত্রই বা কেমন ছিল।

ডোডো পাখির দেখা পেলো মানুষ
মরিশাসের নাম শুনেছো না তোমরা? আরে, এর আগে একবার একটা বিশেষ রচনায় তোমাদেরকে যে হারাতে বসা পাখিদের গল্প শুনিয়েছিলাম না? সেখানে মরিশাস কেস্ট্রেল পাখির গল্প বলেছিলাম, আর বলেছিলাম ডোডো পাখির গল্প আরেকদিন শোনাবো? যারা ভুলে গেছো, আর যারা ওই বিশেষ রচনাটা পড়তে পারোনি, তাদের জন্য লিঙ্ক দিয়ে দিচ্ছি- হারাতে বসা পাখিগুলো


তো ঐ মরিশাসেই বাস করতো এই ডোডো পাখিরা। আর ওদের প্রথম খুঁজে পায় ডাচ বা ওলন্দাজরা, মানে যারা নেদারল্যান্ডে থাকে আরকি। ওরা এই পাখির নাম দেয় “ওয়াগ্লভোগেল”। কেমন খটমটে নাম, তাই না? এই খটমটে নামের অর্থ হচ্ছে অরুচি বা অভক্তি। ভাবছো, এমন পচা নাম ওরা কেনো দিলো? আরে, ডোডো পাখির মাংস নাকি খেতে খুবই বিচ্ছিরি ছিল।

এটা সেই ১৫৯৮ সালের কথা। ১৬০১ সালে সেই ডাচ জাহাজেরই অ্যাডমিরাল- জ্যাকব ভ্যান নেক একটি পত্রিকায় এই পাখির কথা লেখেন। আর তখনই সবাই এই বিচ্ছিরি স্বাদের মাংসের পাখির কথা জানলো। আর সেই লেখাতে তিনি কি বলেছিলেন জানো? পাখিটি নাকি দেখতে অনেকটা পেঙ্গুইনের মতো। সেই সাথে হাতে আঁকা পাখিটির একটা ছবিও ছাপিয়েছিলেন তিনি।



দেখতে কেমন ছিল ডোডো পাখি
ভাবছো, এ আর এমন কি কঠিন কর্ম! পাখি দেখতে কেমন, এটা বলতে আবার সমস্যা কোথায়! আছে আছে, সমস্যা আছে, এই ডোডো পাখি যে ১৭ শতকের আগেই বিলুপ্ত হয়ে গেছে; এখন তুমিই বলো, এই পাখি দেখতে কেমন তা কীভাবে জানা যায়?
তবে একটা ঘটনায় এই কাজে বেশ সুবিধে হয়েছে। একবার অনেকগুলো ডোডো পাখি ইউরোপে ধরে নিয়ে আসা হয়েছিলো। কেন নিয়ে এসেছিলো কে জানে, তবে চিত্রকররা তো আর এই সুযোগ হাতছাড়া করেননি, তারা ডোডো পাখিগুলোর ছবি এঁকে রেখেছিলেন। কিন্তু সমস্যা হলো, একেকজন একেকরকম করে ডোডো পাখি এঁকেছিলেন। হয় তাদের ‘মডেল’ ডোডোগুলো বিভিন্ন বয়সী ছিল, কিংবা বিভিন্ন প্রজাতির ছিল। আবার এমনও হতে পারে কারোটা মেয়ে ডোডো ছিল, কারোটা ছিল ছেলে ডোডো।


ডোডো পাখি গায়ে-গতরে যে বেশ বড়োসড়ো হতো, তা তো আগেই বলেছি। হিসেব করে বললে, ওরা প্রায় সাড়ে তিন ফুট পর্যন্ত লম্বা হতো। আর এক-একজনের ওজনই হতো প্রায় ২০ কেজি। সেই তুলনায় পাখাগুলো যে কত্তো ছোট্ট ছিলো, সে-ও তো শুনেছো। সেই পাখাগুলো বেশ হালকাও হতো। ওদের পাখা হতো সাধারণত ধূসর বা বাদামী রঙের। আর পাখার শেষভাগ একটু কোঁকড়ানো থাকতো। মাথাটা হতো ধূসর আর তাতে কোনো পালক কি পশম কিছুই থাকতো না। আর ঠোঁট ছিলো যেমন লম্বা, তেমনি রংবাহারি; সবুজ-কালো-হলুদ রং মিলে-মিশে থাকতো ওদের ঠোঁটে। কতো লম্বা হতো ওদের ঠোঁট? প্রায় ২৩ সেন্টিমিটার বা ৯ ইঞ্চি! আর ওদের পা গুলো কেমন হতো জানো? মুরগির মতো! পায়ের রং হতো হলুদ, আর নখের রং কালো। তবে দেখতে মুরগির মতো হলেও ওদের পা’জোড়া বেশ শক্তপোক্তও হতো। তা দিয়ে অবশ্য ওরা তেমন জোরে দৌড়াতে পারতো না!

ডোডো পাখির স্বভাব-চরিত্র
ছবি দেখে দেখে না হয় ওরা দেখতে কেমন ছিলো সেটি জানা গেলো, কিন্তু ওদের স্বভাব-চরিত্র কিভাবে জানা যায়, বলো তো দেখি? ঐ যে, লেখালেখি; তখনকার মানুষ যে শুধু ডোডো পাখির ছবিই এঁকেছিলো, তা তো নয়, ওরা ডোডো পাখি সম্বন্ধে অল্প-বিস্তর লেখালেখিও করেছিলো। আর তা থেকে খুব বেশি কিছু জানা না গেলেও হারিয়ে যাওয়া এই নাদুসনুদুস পাখির স্বভাব-চরিত্র সম্পর্কে কিছু অন্তত জানা গেছে। এই যেমন ধরো, ডোডোদের খাবার ছিলো মূলত ফলমূল। আর ওরা বাসা বানাতো মাটিতেই। পাখি হয়েও গাছে বাসা না বানিয়ে মাটিতে কেন বানাতো বলো তো? আরে, ওরা তো উড়তেই পারতো না, গাছের মগডালে গিয়ে বাসা বাঁধবে কি করে! তাই বেচারাদের মাটিতেই বাসা বানিয়ে থাকতে হতো। ঘাস আর খড়কুটা জোগাড় করে সেগুলো দিয়ে জঙ্গলে গাছের গোঁড়ায় বাসা বানাতো ডোডো পাখিরা। আর সেই বাসাতেই ডিম পারতো। মুরগিদের মতোই একটা-একটা করে ডিম পারতো ওরা। আর ডিমগুলো আকারে হতো বেশ বড়োসড়ো, ডিমের রং হতো সাদা।

এদেরকে অনেকে বলতো পেটুক পাখি। আবার অনেকে বলতো লোভী। কারণ মরিশাসে বর্ষাকাল শেষ হলে গাছের ফলগুলো পেকে একদম টসটসে হয়ে থাকতো। আর তখন সেই ফলগুলো দেখে ওরা একদমই লোভ সামলাতে পারতো না; পেটুকের মতো খেতেই থাকতো। খেয়ে খেয়ে সত্যি সত্যিই পেটমোটা হয়ে ঢোল হয়ে যেতো। আর তাতে কি হতো জানো? বর্ষাকালের পর শুকনো মৌসুম এলে ওদের কিছু না খেলেও চলতো; শুকনো মৌসুম ওরা মজাসে ঘোরাঘুরি করে কাটিয়ে দিতো!
আবার, মরিশাসে ‘তাম্বস্বালাচোক’ নাম একধরনের গাছ আছে। এদেরকে আবার ‘ডোডো ট্রি’ও বলা হয়। কারণ, এই গাছ বংশবিস্তারের জন্য পুরোপুরিই ডোডো পাখির ওপর নির্ভরশীল ছিল। গাছটির ফল ডোডো পাখি খেলে তা ওর পেটে গিয়ে প্রক্রিয়াজাত হয়ে বীজ আকারে বের হতো। আর সেই বীজ থেকেই নতুন তাম্বস্বালাচোক গাছের জন্ম হতো। কিন্তু ডোডো পাখি পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার পরে এই গাছ আর ঠিক মতো বংশবিস্তার করতে পারছে না। হয়তো অচিরেই অদ্ভূত এই গাছটিও পৃথিবী থেকে হারিয়ে যাবে। সেক্ষেত্রে আমাদেরও কিচ্ছুটি করার নেই; শত চেষ্টা করলেও তো আর নতুন করে ডোডো পাখি তৈরি করা সম্ভব না!


হারিয়ে গেলো ডোডো পাখি
ডোডো পাখির বিলুপ্তির জন্য দায়ী কে জানো? মানুষ! ডোডো পাখি একে তো উড়তেও পারতো না আবার দৌড়াতেও পারতো না, তার ওপর ছিলো একদম সহজ সরল। আশেপাশে মানুষ দেখলে লুকোনোরও চেষ্টা করতো না! আর মানুষও তাই মজা করে ডোডো পাখি ধরে ধরে রান্না করে খেতো।
ভাবছো, ডোডো পাখির মাংস নাকি খেতে বিচ্ছিরি ছিল। তাহলে ওদের ধরে ধরে খেতো কেন সবাই? আরে, ওদের মাংস খেতে মজা ছিল না, কিন্তু ওদের পাকস্থলী আর বুকের মাংস ছিল খুবই মজার। তার ওপর তখন মরিশাসে খাওয়ার জন্য আর কোন পশুপাখিও সহজে পাওয়া যেতো না। তাই মানুষ মাংসের জন্য ডোডোদের উপরই হামলা চালাতো। আর তখনও তো মানুষ এমন কিছু সচেতনও হয়নি, যে ডোডো পাখি সংরক্ষণের জন্য কোনো উদ্যোগ নেবে। ফলাফল, ১৭০০ সালের মধ্যে পৃথিবী থেকে হারিয়ে গেলো পেটুক পাখি ডোডো; কী অদ্ভূত ব্যাপার দেখো, যারা নিজেরাই বেশি বেশি খাওয়ার জন্য ছিলো বিখ্যাত, মানুষ তাদেরকেই বেশি বেশি করে খেয়ে একেবারে নিঃশেষ করে ফেললো মানুষ!
এই হলো হারিয়ে যাওয়া নাদুসনুদুস আর ভীষণ পেটুক ডোডো পাখির গল্প। শুনে নিশ্চয়ই খুবই মন খারাপ হয়ে গেছে তোমাদের? তোমাদের আর কী বলবো, বলতে বলতে আমারই তো মন খারাপ হয়ে গেলো। তবে মন খারাপ করে তো আর লাভ নেই। তারচেয়ে বরং যেসব পশুপাখিগুলো এখনো হারিয়ে যায় নি, পৃথিবীতে টিকে আছে, বিশেষ করে যেগুলো বিলুপ্ত হওয়ার পথে, সেগুলো যাতে বিলুপ্ত হয়ে না যায়, পৃথিবী থেকে হারিয়ে না যায়, সেদিকেই আমাদের নজর দেয়া উচিত। তোমরা কি বলো, তাই কি উচিত না? তাহলেই এই ডোডো পাখিদের মতো আর কোন পশুপাখিকে পৃথিবী থেকে হারিয়ে যেতে হবে না। তখন তোমরা এরকম গল্প বলবে- যে পাখিগুলো হারিয়ে যেতে বসেছিল, কিন্তু আমরা ওদের হারাতে দেইনি।

Blogger templates

.
Recommended Post Slide Out For Blogger