মায়া সভ্যতার মায়ায়

|
‘মায়া সভ্যতা’- শব্দ দু’টিতেই কেমন একটা রহস্যের গন্ধ আছে, তাইনা? না জানি এই সভ্যতায় আরো কতো রহস্য লুকিয়ে আছে। এমনিতেই তো পুরোনো সভ্যতার গল্পগুলো কতো মজার হয়। কেন, কিছুদিন আগে তোমাদেরকে যে ইনকা সভ্যতার গল্প বলা হয়েছিল, মনে নেই? সেই গল্পগুলোও তো কত্তো মজার ছিল। একটা ছিল ইনকাদের বিখ্যাত শহর মাচু পিচুর গল্প, আরেকটা ছিল ওদের মমি হয়ে যাওয়া তিন শিশুর গল্প। তোমরা যারা পড়তে ভুলে গেছো, তোমাদের জন্য মাচু পিচু শহরের গল্পটির লিঙ্কও দিয়ে দিলাম- ইনকাদের হারিয়ে যাওয়া শহর-

তবে এবারের গল্পটি কিন্তু সেই গল্পের চেয়ে একদমই আলাদা। আজকে তোমাদেরকে মায়ানদের কোনো শহরের গল্প শোনাবো না, আজকে তোমাদেরকে শোনাবো পুরো মায়া সভ্যতার গল্পই। কিন্তু তার আগে কিছু গোড়ার কথা বলে নেই। আমাদের এই পৃথিবী নামের গ্রহটাতে মানুষের জন্ম হয়েছে খুব বেশিদিন হয়নি। কিন্তু পৃথিবীর জন্ম হয়েছে বহু আগেই, প্রায় ৪৬০ কোটি বছর আগে। তখন অবশ্য পৃথিবী আজকের মতো এতো সুন্দর আর ফুলে-ফলে-পাহাড়ে-পর্বতে-সাগরে সাজানো ছিল না; ছিল একটা প্রাণহীন লাভাপিণ্ড। ধীরে ধীরে ঠাণ্ডা হয়ে প্রথমে পৃথিবী প্রাণীদের বাসের উপযোগী হয়। তবে, প্রাণের উদ্ভব হয় আরো অ-নে-ক পরে, মোটামুটি ৬০ কোটি বছর আগে!

সে প্রাণীও কিন্তু মানুষ নয়। মানুষ সব প্রাণীদের মধ্যে সবচেয়ে বুদ্ধিমান হলে কি হবে, পৃথিবীতে মানুষের উদ্ভব হয়েছে কিন্তু সবার শেষে। মানুষের জন্মের আগে হাজার হাজার প্রজাতির প্রাণীরা দাপিয়ে বেড়িয়েছে এই পৃথিবী, আবার তাদের অনেকে হারিয়েও গেছে। তোমরা নিশ্চয়ই ডাইনোসরের কথা শুনেছ এবং সিনেমাতেও দেখেছ। তারাও কিন্তু এ পৃথিবীতে এসেছিল কোটি কোটি বছর আগে। প্রায় ১৬ কোটি বছর আগে তারা বিলুপ্তও হয়ে গেছে পৃথিবী থেকে। ডাইনোসরের গল্পও তো তোমাদেরকে একদিন বলা হয়েছিল, মনে নেই? আচ্ছা দাঁড়াও, তোমাদেরকে সেই গল্পেরও লিঙ্ক দিয়ে দিচ্ছি, সময় করে পড়ে নিও- ডাইনোসর! ডাইনোসর!
এমনকি মাছ, বানর, শিম্পাঞ্জীদের জন্মও হয়েছে মানুষের আগে। মানুষের জন্ম হয় মাত্র ৭০ লাখ বছর আগে। আর তখন মানুষ দেখতেও আমাদের মতো ছিল না। তারা আমাদের মতো সোজা হয়ে হাঁটতে চলতেও পারতো না, আবার কথাও বলতে পারতো না। এমনকি, শুধু খাবার আর আশ্রয়ের চিন্তা ছাড়া অন্য কোনো চিন্তাও তারা করতে পারতো না। খুব কষ্ট করে অনেক বুদ্ধি খাটিয়ে তারা ফলমূল সংগ্রহ করে জীবন কাটাতো। আর গাছে, বড় কোটরে নয়তো গুহায় বাস করতো। আস্তে আস্তে তারা আগুন জ্বালাতে শিখলো, আকার-ইঙ্গিতের মাধ্যমে মনের ভাব প্রকাশ করতে শিখলো, তারপর এক সময় কথা বলাও শিখে ফেললো, হিংগ্র পশুদের হাত থেকে বাঁচার জন্য দলবদ্ধভাবে থাকতে শুরু করলো; এভাবে একটার পর একটা সমস্যা সমাধানের মাধ্যমে তাদের বুদ্ধি বিকাশ ঘটতে লাগলো, তারা বুদ্ধির ব্যবহার করতে শিখলো। এভাবেই এক একটি দলবদ্ধ বা গোষ্ঠীবদ্ধ মানুষ যখন আরো উন্নত হলো, তখনই গঠিত হল তাদের সমাজ, তাদের সভ্যতা।


প্রথম মানবসমাজের উদ্ভব হয়েছিল আফ্রিকা মহাদেশে, প্রায় ২ লক্ষ বছর আগে। তার মানে আফ্রিকাকে আমরা আমাদের, মানে মানুষের আদি নিবাস বলতে পারি, তাই না? যা হোক, এরও প্রায় ৭০ হাজার বছর পরে, তার মানে আজ থেকে প্রায় ১ লক্ষ ৩০ হাজার বছর আগে তারা ছড়িয়ে পড়তে লাগলো আফ্রিকার বাইরে, পৃথিবীর অন্যান্য জায়গাগুলোতে। প্রায় ৯০ হাজার বছর আগে তারা ইউরোপে আর মধ্যপ্রাচ্যে পৌঁছায়। তবে সবচেয়ে মজার কথা কি জানো? এখন যে আমেরিকা শিক্ষায়-প্রযুক্তিতে সবার চেয়ে এগিয়ে, সেই আমেরিকা মহাদেশেই মানুষ পৌঁছায় সবার শেষে; আজ থেকে মাত্র ১৫ হাজার বছর আগে!

অনেক তো গোড়ার কথা হলো, এবার চল ফিরে আসা যাক মায়া সভ্যতার গল্পে। এই মায়া সভ্যতার লোকেদের, মানে মায়ানদের কথা শুনলে তোমরা এমনই অবাক হবে, ভেবেই কূল পাবে না সেই চার হাজার বছর আগে কীভাবে তারা এত উন্নত হয়েছিল? যখন পৃথিবীর মানুষরা বাড়িঘরই ঠিকঠাক বানাতে শেখেনি, কেবল আগুন জ্বালিয়ে খাবার সেদ্ধ করা শিখেছিল, সেই সময় তারা কীভাবে পাথর দিয়ে তৈরি করেছিল বিশাল বিশাল সব ঘরবাড়ি! আর সেই সব ঘরবাড়ি কতো বিশাল? তা আজকের দিনের প্রায় বিশ পঁচিশ তলা বিল্ডিংয়ের সমান তো হবেই! যখন কেউ লিখতে-পড়তে তো দূরে থাক, অধিকাংশ জাতির ভাষাই পুরোপুরি গড়ে ওঠেনি, তখন তারা তাদের ভাষায় এমনকি একরকম ক্যালেন্ডারও বানিয়ে ফেলেছিল। চাঁদ, তারা, গ্রহ-নক্ষত্র নিয়েও তারা পড়াশুনা করত, যাকে বলে কিনা জ্যোতির্বিদ্যা। শুধু তাই না, ওরা গান গাইত, কবিতা লিখত; রীতিমত সাহিত্য চর্চা করতো! কী অবাক কাণ্ড, তাইনা? আরও একটা মজার কথা কি জানো, পুরো আমেরিকা (উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকা) মাহাদেশজুড়ে মায়া সভ্যতাই একমাত্র প্রাচীন সভ্যতা, যাদের নিজস্ব লেখ্য ভাষা ছিল, যারা আমাদের মতই সুন্দর করে পড়তে এবং লিখতে জানতো।
এই মায়া সভ্যতা আমাদের থেকে হাজার হাজার মাইল দূরের আরেক মহাদেশের একটি সভ্যতা। তবে বহু দূরের হলে কী হবে, এই সভ্যতার গল্প এতই বিখ্যাত আর মজার, সারা পৃথিবীর লোকের মুখে মুখে ফেরে সেই গল্প। এবং যারা দেশে বিদেশে ভ্রমণ করে, মানে পর্যটকদের কাছে মায়া সভ্যতার নিদর্শন, মানে মায়ানদের শহর, বাড়িঘর, পুরাকীর্তি আর আর সবকিছুই খুবই পছন্দের। এমন ভ্রমণপিপাসু মানুষ খুব কমই আছেন, যিনি পৃথিবী ঘুরে বেড়িয়েছেন, অথচ মায়া সভ্যতার নিদর্শন দেখতে যাননি। বড় হলে তোমরাও হয়তো একদিন যাবে সেখানে, ওদের অদ্ভ‚ত সব কীর্তিকলাপ দেখে বিস্ময়ে বিমূঢ় হবে, আবার খুব মজাও পাবে। তার আগে চলো, আজকে ওদের যতো গল্প আছে চটজলদি আজ জেনে নেই।


মায়াদের দেখতে হলে তোমাদের যেতে হবে সেই সুদূর আমেরিকা মহাদেশে- ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, মেক্সিকো, কিউবা, ভেনিজুয়েলা, হন্ডুরাস এইসব দেশে। কী, মনে পড়ে গেল ফুটবলের কথা, তাই না? হ্যাঁ, এসব দেশের মানুষজনের প্রিয় খেলা ফুটবল। মেক্সিকোতেও ফুটবল সবার প্রিয়। সে যাই হোক, হন্ডুরাস, গুয়াতেমালা, এল সালভেদরের উত্তরাংশ, কেন্দ্রীয় মেক্সিকোসহ আরো প্রায় ১ হাজার কিলোমিটার এলাকা জুড়ে ছিল মায়ানদের বসবাস।

কিন্তু কীভাবে জন্ম হলো মায়া সভ্যতার? কীভাবেই বা এই সভ্যতা সেই আদিম যুগেও এতো বিকশিত হল, বা উন্নত হলো? এবার এসো সে সবই জেনে নেই। মায়া সভ্যতার মানুষজন প্রথম কবে এই এলাকায় এসেছিল তা জানা যায়নি। তবে খ্রিষ্টের জন্মেরও প্রায় ২০০০ হাজার বছর আগে, মানে ইংরেজি সাল গণনা শুরুরও প্রায় ২০০০ হাজার বছর (খ্রিষ্টপূর্ব ২০০০ সাল) আগের মায়ান ভাষার লেখ্য রূপ পাওয়া গেছে। তার মানে, তারা খ্রিষ্টপূর্ব ২০০০ সালেরও বহু আগে থেকে সেখানে বাস করে আসছিল। এই সময়ের আগে মায়ানরা ছিল যাযাবর। তারা খাদ্য, পানি এবং আশ্রয়ের জন্য এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যেত। কী অবাক লাগছে না? তোমাদের মনে হয়তো প্রশ্ন জাগছে কেন তারা তোমাদের আব্বু আম্মুর মত বাসায়, অফিসে বা বাজারে না গিয়ে খাবার আর আশ্রয়ের জন্য এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যেত, তাই না? এর কারণ হল, তখনও পৃথিবীতে কোথাও অফিস কি বাজার তৈরি হয়নি, এমনকি তখনো ঘরবাড়িও তৈরি হয়নি। ওই অঞ্চলে মায়ানরাই প্রথম বাড়িঘর তৈরি করে। খ্রিষ্টপূর্ব ১৮০০ সাল থেকে তারা ওই অঞ্চলে পশুপালন শুরু করে, আর বানাতে শুরু করে মাটি দিয়ে নানারকম তৈজসপত্র, যেমন থালা-বাসন, বাটি, হাঁড়ি-পাতিল প্রভৃতি। ফলে তারা পশু থেকে মাংস আর মাটি থেকে তৈরি তৈজসপত্র পেতে লাগলো। ফলে তাদের খাবার আর খাবার রাখার পাত্রের আর কোন অভাব রইলো না। যখন খাবারের চিন্তা আর রইলোই না, তখন আর যাযাবরের মতো বনে-জঙ্গলে এখানে-ওখানে ঘোরাঘুরি করারই বা কী দরকার? তারা যাযাবর জীবন ত্যাগ করে ঘরবাড়ি বানিয়ে এক জায়াগাতেই বাস করতে শুরু করলো।

এখন তো মাথা থেকে খাদ্য আর বাসস্থানের দুশ্চিন্তা গেল, এবার তারা আরো উন্নত চিন্তা-ভাবনা করার ফুরসত পেল। তারা মৃতদেহের সৎকার করা শিখলো, মৃতদেহের উপর সমাধিও নির্মাণ করতে শুরু করলো। এভাবেই মায়ানরা ধারণা পেয়ে গেল পিরামিড ও মমি নির্মাণের। মিসরের সুউচ্চ পিরামিড এবং মমির কথা তোমরা সবাই-ই শুনেছ। একদম সেরকম বিশাল না হলেও সেই ছাঁচের মমি ও পিরামিড তৈরি করতো তারা।


২৫০ থেকে ৯০৯ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে তৈরি মায়ানদের অনেক শহর আর সৌধও পাওয়া গেছে। তাদের শহরগুলোর নামগুলোও আবার ভীষণ মজার মজার। যেমন ধরো- টিকাল, পালেন্ক, কোপান, কালাকমূল, ডসপিলাস, আক্সাকটান, আলটানহা, তারপর বোনামপাক। আর তাদের সবচেয়ে বিখ্যাত সৌধটির নাম হল ক্যানচুয়েন। এটিই ছিল তাদের রাজপ্রাসাদ, একই সাথে প্রার্থণালয়-ও। তারা একটি পাথরের মূর্তিও তৈরি করেছিল, তাদের ভাষায় এই মূর্তিটির নাম ‘টেটান’ বা পাথরের গাছ। এই মূর্তিটি ছিল তাদের সকল বীরত্বপূর্ণ কাজ ও সর্বশক্তিমান শাসকের প্রতীক। আচ্ছা, নীল বিদ্রোহের কথা শুনেছো না তোমরা? আর সিরামিকের কথাও তো শুনেছো, তোমার বাসাতেও কিন্তু সিরামিকের অনেক থালা-বাসনও আছে। এই নীল রং আর সিরামিকের প্রচলনও প্রথম করেছিল এই মায়ানরাই।

মায়া সভ্যতা বিখ্যাত হয়ে আছে ওদের স্থাপত্যশিল্পের জন্য, ওদের তৈরি বিশাল বিশাল ঘরবাড়ি, ওদের তৈরি পিরামিড আর মূর্তিগুলোর জন্য। এখনও মায়া সভ্যতার বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে তাদের তৈরি পিরামিড, ঘরবাড়ি, প্রাসাদ আর অট্টালিকা। আচ্ছা, ওদের কয়েকটা বিখ্যাত স্থাপত্যের নাম বলি তোমাদের, শোনো- চেচেন ইটজা, নর্থ আ্যাক্রপলিস, টিকাল, গুয়াতেমালা এন্ড বলকোর্ট আ্যাট টিকাল, এল মিরাডর।

আচ্ছা, এবার বলো তো, মায়ানরা এসব ঘরবাড়ি-পিরামিড-প্রাসাদ কী দিয়ে বানাতো? ভাবছো, এ আবার এমন কী কঠিন প্রশ্ন! ঘরবাড়ি আবার কী দিয়ে বানাবো, ইট-কাঠ-সিমেন্ট-বালু-রড এসব দিয়েই তো বানাবে। উঁহু, তখন কী আর এসব ছিল নাকি? তারা এসব ঘরবাড়ি বানাত লাইমস্টোন নামের এক ধরনের পাথর দিয়ে। এই পাথরকে বাংলায় বলা হয় চুনাপাথর। আর সেই পাথরগুলোকে সুন্দর মসৃণ করতে ব্যবহার করতো সিমেন্টের মত এক ধরনের পদার্থ। আর সেগুলো দিয়ে ঘরবাড়ি তৈরি করতে হাজার হাজার শ্রমিক দিনের পর দিন পরিশ্রম করতো। তবেই না তৈরি হতো অমন বিশাল বিশাল আর সুন্দর সুন্দর সব ঘরবাড়ি-পিরামিড-প্রাসাদ-অট্টালিকা।


শুধু ওদের ঘরবাড়ি নির্মাণের পদ্ধতিই অদ্ভ‚ত ছিল না, ওদের ভাষাও ছিল অদ্ভূত। ওরা আমাদের মতো একটার পর আরেকটা বর্ণ লিখতো না, আসলে ওরা লেখার জন্য বর্ণই ব্যবহার করতো না; ওরা লিখত ছবি বা চিহ্ন দিয়ে। আর লেখার জন্য মায়ানরা ব্যবহারও করতো অনেক মজার মজার সব জিনিস। যেহেতু ওরা বর্ণ ব্যবহার করতো না, ছবি এঁকে লিখত, তাই ওরা কলম ব্যবহার না করে ব্যবহার করতো তুলি; সত্যি বলতে কি, তখন তো আর কলম আবিষ্কৃত হয়নি, যে তোমাদের মতো সুন্দর সুন্দর কলম দিয়ে লিখবে! আর তারা তুলিগুলো তৈরি করত পশুর লোম বা পশম দিয়ে, তোমাদের তুলিগুলোর মত প্লাস্টিক দিয়ে না।

শুধু তাই না, মায়ানরা সেই সময়েই গণিতে বেশ পারদর্শী হয়ে উঠেছিল। অবশ্য তোমাদের মতো কঠিন কঠিন অঙ্ক ওরা করতে পারতো না, তখনো গণিতের এতোটা উন্নতিই হয়নি! তবে ‘শূণ্য’ আবিষ্কার কিন্তু প্রাচীন গণিতের খুব বড়ো এক আবিষ্কার। আর এ আবিষ্কারে মায়ানদেরও কিছুটা অবদান আছে। তবে তাদের আবিষ্কৃত ‘শূণ্য’ অন্যান্য সভ্যতায় তেমন কোনো প্রভাব ফেলতে পারেনি, তাই তারা ‘শূণ্য’-র আবিষ্কারকও হতে পারেনি। শুধু গণিতে না, তারা জ্যোতির্বিজ্ঞানেও বেশ অবদান রেখেছিল; তারাই প্রথম খালি চোখেই গ্রহ নক্ষত্রদের চলাফেরা পর্যবেক্ষণ করে হিসেব করে তাদের গতি-প্রকৃতি নির্ণয় করেছিল।

এতোক্ষণ তো সব মজার মজার তথ্য বললাম, এইবার যেই গল্পটা বলব, সেটা কিন্তু মোটেই মজার কোনো গল্প না; বরং এটা বেশ ভয়েরই একটা গল্প। মায়ানরা কিন্তু ধর্মের দিক থেকে প্রকৃতি বিশ্বাসী ছিল, মানে ওরা বিভিন্ন প্রাকৃতিক শক্তিকে তাদের আরাধ্য দেবতা ভেবে পূজা করত। আর এই পূজার একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল নরবলি দেয়া; তারা তাদের আরাধ্য দেবতাদের খুশি করার জন্য নরবলি দিত, সোজা কথায় মানুষ মেরে ফেলত! আর এই বলি দেয়া হতো তাদের নিজেদের গোষ্ঠীর কাউকে নয়, অন্য গোত্রের মানুষদের। মায়ানদের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শহর চিচেন ইতজা ছিল নরবলিরও অন্যতম প্রধান ক্ষেত্র। এই শহরে দুটি প্রধান প্রাকৃতিক জলাধার ছিল, ওগুলো থেকে পুরো শহরে খাওয়ার পানি সরবরাহ করা হতো। এদের মধ্যে সবচেয়ে বড়ো যেটি, শিনত সাগ্রাড, সেটাতেই বৃষ্টির দেবতার উদ্দেশ্যে নরবলি করা হত। আর এ কারণেই এই জলাধারটির আরেক নাম ছিল উৎসর্গের জলাধার। ইশশ্ কী ভয়ংকর, তাই না?

এবার তোমাদেরকে মায়ানদের আরেকটি ভাল দিকের কথা বলি। তারা কিন্তু বেশ চুটিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্যও করতো। আর ওদের বাণিজ্য ছিল মূলত কৃষি নির্ভর; তখন যে কল-কারখানা আবিষ্কারই হয়নি! ওদের প্রধান ফসল ছিল- আলু, ভুট্টা, সিম, স্কোয়াশ। আর ওরা ব্যবসা-বাণিজ্য করত বিনিময় প্রথায়, কেন? তখনো তো টাকা পয়সাই ছিল না। এছাড়া তারা লবন পাথরেরও বিকিকিনি করতো। আর তাদের এ বাণিজ্য নিজেদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না, অন্যান্য জনগোষ্ঠীর সঙ্গেও তারা ব্যবসা-বাণিজ্য করতো।

এভাবে শিল্প-সাহিত্য-স্থাপত্য-ব্যবসা-বাণিজ্য-জ্ঞান-বিজ্ঞানে তারা উন্নতি সাধন করেছিল অনেক। কিন্তু কোনো কিছুই চিরদিন থাকে না, সবকিছুই একদিন ধ্বসে যায়, ধ্বংস হয়। প্রায় তিন হাজার বছর বীরদর্পে আমেরিকা দাপিয়ে বেড়ানো সভ্যতাও একদিন বিপর্যয়ের সম্মুখীন হলো। ৯০০-১০০০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে মায়ান সভ্যতা বিপর্যয়ের মুখে পড়লো। তবে গবেষকগণ ঠিক ঠিক করে বলতে পারেননি, কী কারণে মায়া সভ্যতা ধ্বংস হয়েছিল। কেউ বলেন, মহামারীর কারণে, কেউ বলেন, জনসংখ্যার তুলনায় খাবারের অপর্যাপ্ততার কারণে, আবার কেউ বলেন, পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণে একসঙ্গে অনেক মানুষ মারা গিয়েছিল।
আর তারপর থেকেই মায়ানরা বিভক্ত হয়ে যেতে থাকে, অনেক দল অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীদের সঙ্গে মিশে যেতে থাকে। ১৪৫০ সালে পুরো মধ্য আমেরিকায় বিপ্লব সংঘঠিত হয়। তখন মায়ানরা আরো ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে যায়। মায়া সভ্যতার কিছু অংশ আবার স্প্যানিশরা দখল করে নেয়। মায়ানরা জ্ঞান-বিজ্ঞান-ব্যবসা-বাণিজ্যে উন্নত হলেও সামরিক দিক দিয়ে, মানে অস্ত্র-শস্ত্রের দিক দিয়ে স্প্যানিশরা ছিল অনেক এগিয়ে। তাই শক্ত প্রতিরোধের মুখে পড়লেও শেষ পর্যন্ত মায়ানদের অঞ্চলগুলো দখল করে নেয় স্প্যানিশরা। তবে মায়ানদের বেশ একটা সুবিধা ছিল, ওদের কোনো রাজধানী ছিল না, ওদের প্রতিটি শহরই ছিল বিজ্ঞান-সংস্কৃতি-বাণিজ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। তাই স্প্যানিশদের প্রতিটি মায়ান শহরকেই আলাদা আলাদা করে জয় করতে হয়েছে। তাই সময়ও লেগেছে অনেক। শেষমেশ ১৬৯৭ সালে এসে পুরো মায়া সভ্যতাই স্প্যানিয়ার্ডদের দখলে আসে।
এরপরের ইতিহাস বলবো আরেকদিন। তবে এটুকু বলি, মায়ানরা এখনো পৃথিবীর বুক থেকে হারিয়ে যায়নি। ওদের পূর্বপুরুষদের স্থাপনাগুলো যেমন সগৌরবে এখনো দাড়িয়ে আছে পৃথিবীর বুকে, বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ হয়ে, তেমনি এখনও মধ্য আমেরিকায় প্রায় ৬০ লক্ষ মায়ান বাস করছে নিজেদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য বজায় রেখে। আমরা যেমন বাঙালীরা এখনো বাংলা নববর্ষ পালন করি, ওরাও ওদের ক্যালেন্ডার অনুযায়ী মহা ধুমধাম করে নববর্ষ পালন করে। তবে নরবলির মতো বর্বর প্রথা অবশ্য বিলুপ্ত হয়েছে অনেক আগেই। এখন তারা আধুনিক বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে জীবন যাপন করছে, একইসঙ্গে নিজেদের ইতিহাস-ঐতিহ্যও বজায় রেখেছে। নিজেদের পূর্বপুরুষদের শিকড়কে, ঐতিহ্যকে তারা হারিয়ে যেতে দেয়নি।

মায়ানদের মতো আমাদের বাঙালিদেরও কিন্তু নিজস্ব ইতিহাস আছে, ঐতিহ্য আছে, নিজস্ব শিকড় আছে। আমাদেরকেও কিন্তু সেই ঐতিহ্য রক্ষা করে চলতে হবে। আবার শুধু নিজেদের ঐতিহ্য রক্ষা করলেই চলবে না, একইসঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হবে বিশ্বের সঙ্গে, আধুনিকতার সঙ্গে। আমাদের নববর্ষ যেমন পালন করতে হবে, তেমনি কুসংস্কারগুলো মুছে জ্ঞান-বিজ্ঞানের অগ্রগতির সঙ্গেও আমাদের তাল মিলিয়ে চলতে হবে। তাহলেই না আমরা পৃথিবীর বুকে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবো, পৃথিবীর নানা দেশের নানা জাতির মানুষ আমাদের ইতিহাস আগ্রহ নিয়ে পড়বে, আর ভাববে, ইশ্শ, বাঙালিরা না জানি কী সাংঘাতিক বুদ্ধিমান একটা জাতি!

Blogger templates

.
Recommended Post Slide Out For Blogger