দ্বীপের নাম নিঝুম দ্বীপ

|
নিঝুম দ্বীপ কিন্তু পানির ভেতরে লুকিয়ে ছিলো অনেক দিন। ১৯৭২ সালের দিকে বন বিভাগের লোকজন এই বনটি আবিষ্কার করে। তখন তারা দ্বীপটিতে কেওড়া গাছ লাগিয়ে দিয়েছিলো। কেওড়া গাছের বৈশিষ্ট্য হলো- এতে শ্বাসমূল থাকে। শ্বাসমূল তো চেনোই। যে কোনো ম্যানগ্রোভ বনে গেলে দেখবে গাছগুলোর চারপাশে মাটি থেকে ছোট ছোট খুটির মতো কি যেনো বের হয়ে আছে। এগুলোই শ্বাসমূল। বনে লোনা পানি ঢুকে গেলে গাছগুলো আর মাটি থেকে শ্বাস নিতে পারে না। তখন শ্বাসমূলগুলো দিয়ে তারা নিঃশ্বাস নেয়। এজন্য যেখানে পানি বেশি ওঠে সেখানে শ্বাসমূলও বেশি লম্বা হয়। শ্বাসমূল থাকে বলেই কেওড়া গাছ লোনা জলেও ভালোভাবে বাঁচতে পারে। এখন তো সেখানে কেওড়া গাছের ঘন বনই হয়ে গেছে। তবে দ্বীপের যে অংশে মানুষ থাকে সেখানে তুমি বিভিন্ন ফুলেরও দেখা পাবে। তবে সেগুলো আসলে মানুষই আশেপাশের দ্বীপগুলো থেকে আসার সময় নিয়ে এসেছে।

নিঝুম দ্বীপের বনে আগে তেমন কোনো প্রাণীই ছিলো না। এখন কেবল হরিণ আছে। হরিণের মোট সংখ্যা কম করে হলেও এখন ২০ হাজার। ভাবতেই পারো যে, এতো হরিণ কোত্থেকে এলো? ১৯৭৮ সালে বাংলাদেশ সরকার সুন্দরবন থেকে মাত্র ৮টি হরিণ এনে ছেড়ে দিয়েছিলো। সেগুলোই এখনকার ২০ হাজার হরিণের পূর্বপুরুষ। এখানে তো আর বাঘ কি কুমির কিছুই নেই যে হরিণ ধরে ধরে খাবে। তাই দিন দিন হরিণের সংখ্যা বেড়েই যাচ্ছে। এখন নাকি বাংলাদেশ সরকার এ বন থেকে হরিণ সরিয়ে অন্য বনে নেয়ার চিন্তা করছে। এছাড়াও এই বনে আছে অনেক পাখি। বক, চখাচখি, গাংচিল, আরো কতো পাখি! সব মিলিয়ে কম করে হলেও ৩৫ প্রজাতির পাখি আছে ওখানে। শীতকালে আবার এদের সঙ্গে যোগ দেয় নানা নামের আর নানা রঙের অতিথি পাখি।

তোমার নিশ্চই জানতে ইচ্ছা হচ্ছে নিঝুম দ্বীপ কোথায়? শোন তবে, নিঝুম দ্বীপ হচ্ছে হাতিয়া ছাড়িয়ে আরো দক্ষিণে। তবে যদি জিজ্ঞেস করো কোন জেলায়, তাহলে বলতে হবে নোয়াখালী জেলায়। মেঘনা নদীর মোহনাতেই নিঝুম দ্বীপের অবস্থান। কোনো নদী যেখানে সাগরে গিয়ে মেশে তাকে বলে সেই নদীর মোহনা। দ্বীপ শুনলেই তো মাথায় আসে চারপাশে সাগর আর সাগর। এতক্ষণে নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছো আমাদের নিঝুম দ্বীপ বঙ্গোপসাগরের কাছে হলেও এর চারপাশে সাগর নেই। আছে মেঘনা নদী।
যেতে হলে জানতে হবে


যদি যেতেই চাও নিঝুম দ্বীপে হরিণ দেখতে তবে তো বেশ কিছু জিনিস কিন্তু জেনেই যেতে হবে। প্রথমেই জানতে হবে, সেখানে যাবে কিভাবে! নিঝুম দ্বীপ নোয়াখালী জেলার মধ্যে পড়লেও যাওয়ার সময় কিন্তু নোয়াখালী গেলে চলবে না । তোমাকে হাতিয়া পার হয়েও আরো অনেক দূর যেতে হবে। এমনকি ওখানে তুমি সরাসরি লঞ্চও পাবে না। তোমাকে ঢাকা থেকে প্রথমে লঞ্চে করে যেতে হবে তমরুদ্দি ঘাটে। তমরুদ্দি ঘাট কিন্তু নিঝুম দ্বীপে নয়, হাতিয়ায়। ঘাটে নেমে একটা কাঠের তৈরি অনেকটা টেম্পোর মতো বাসে করে তোমাকে যেতে হবে বাজারে। বাস ভাড়াই ৩০ টাকা। সেখান থেকে আবার রিকশায় করে নিঝুম দ্বীপে নামার বাজারে। রিকশায় যেতে হবে বলে ভেবো না দূরত্বটা নেহাত কম। রিকশা ভাড়া এ যাত্রা মোটে ৫০-৬০ টাকা! এরপর একটা বড় গাং আছে, মানে নদী। মেঘনারই কোনো একটা শাখা নদী। ট্রলারে করে পার হতে লাগবে ৫ মিনিটের মতো। ভাড়া জনপ্রতি ১০ টাকা। যাক, এবারে তুমি নিঝুম দ্বীপে এসে গেছো। কিন্তু এটা আসলে নিঝুম দ্বীপের একপ্রান্ত। নিঝুম দ্বীপের আসল সৌন্দর্য্য দেখতে হলে যেতে হবে অন্যপ্রান্তে। সেজন্য তোমাকে আবার রিকশা নিতে হবে। এবারে রিকশা ভাড়া কতো হতে পারে আন্দাজ করতে পারো? এই ১৫০-২০০ টাকা! তবে তুমি যদি ইতিমধ্যে ক্লান্ত না হয়ে যাও, তবে এই যাত্রাটা পায়ে হেঁটেই করতে পারো। রাস্তা চিনবে কিভাবে? সে নিয়ে চিন্তা করার কোনোও দরকার নেই। কারণ রাস্তা হারানোর কোনোই সম্ভাবনা নেই। পুরো দ্বীপে রাস্তাই যে একটা। সেটাও অবশ্য পুরো পাকা নয়, বেশিরভাগটাই ইট বিছানো। আর হাটা শুরু করলে একটু পরেই শুরু হবে কেওড়াবন। দুপাশে দেখবে কেওড়াগাছ আর কেওড়াগাছ। নিচু জায়গা তাই পানিও জমে থাকে। আর সেখানে দেখবে কতো যে পাখি। এই দেখলে একটা বক বসে আছে তো আরেকটা বক উড়ে গেলো। ওই শুনলে আরেকটা নাম না জানা পাখি ডেকে উঠলো। এমন রাস্তায় হাঁটতেই তো ভালো লাগে।
তবে তমরুদ্দি ঘাট থেকে এতো কষ্ট করে না গিয়ে একবারে ট্রলারে করেও যেতে পারো। সেক্ষেত্রে তোমরা একসঙ্গে ১০-১৫ জন থাকলে ভালো হবে। কারণ ট্রলার ভাড়া কম করে হলেও ৩৫০০-৪০০০ টাকা নেবে। শীতকালে আরো বেশিও নিতে পারে। কারণ তখন মানুষও ওখানে বেশি যায়।

নিঝুম দ্বীপে তো পৌঁছনো গেলো, এবারে প্রথম চিন্তাটা হচ্ছে- থাকবে কোথায়? আবাসিক হোটেল সেখানে নেই। তবে থাকার জায়গা আছে। একটা সরকারি বাংলো মতো আছে, তবে সেটার ভাড়াও বেশি, সুবিধাও নেই কোনো। ফ্যান লাইট সবই আছে, কিন্তু বিদ্যুৎই তো থাকে না। বিদ্যুৎ আসে রাত ৮টার দিকে। আর চলে যায় রাত ১০টায়। তবে প্রায় সব দোকানেই দেখবে এরপরও লাইট জ্বলছে। সেগুলো জ্বালানো হয় সৌরবিদ্যুৎ দিয়ে। প্রায় প্রত্যেকটি দোকানেরই ছাদে সোলার বোর্ড লাগানো আছে। ওখানে সারাদিনে যতো সূর্যের আলো পড়ে ততো বিদ্যুৎ তৈরি হতে থাকে। এই বিদ্যুতই রাতে আলো দেয়। যদি নিঝুম দ্বীপের সেই সরকারি বাংলোতে থাকতেই চাও তবে আগে থেকেই বুকিং দিতে হবে। নাহলে রুম খালি নাও পেতে পারো। যদি সে বিপদে পড়েই যাও, উপায় কিন্তু একটা আছে। বাংলোর একটু পাশেই একটা বোর্ডিং আছে। তাতে থাকলে যেমন ভাড়া একেবারেই নামে মাত্র, আতিথেয়তাও পাবে বেশ।
নিঝুম দ্বীপের নদী

নিঝুম দ্বীপ সত্যিই অসাধারণ জায়গা। যেমন সুন্দর, তেমনি রোমাঞ্চকর। নদী আছে, বন আছে, গ্রামের সরল মানুষ আছে, অসাধারণ সুন্দর সব পাখি আছে আর আছে হরিণ।

দ্বীপে নেমেই যে কাজটি করতে পারো, তা হলো নদীতে গোসল করা। তবে বেশিক্ষণ ঝাপাঝাপি করা যাবে না। লোনা পানিতে বেশিক্ষণ থাকলে সমস্যা হয়। গা চুলকোয়। সুতরাং গিয়ে ঝটপট নদীতে গোসল সেরে নিতে হবে। নদীতে যাওয়ার সময় পাড়ে জোঁক দেখে ভয় পেয়ো না যেনো। দেখতে জোঁক মনে হলেও ওগুলো আসলে পানির পোকা। কিছুই করে না। তবে নদীতে কাঁকড়া আছে। সহজে কিছু করবে না, কিন্তু একবার ওর সাঁড়াশির মতো হাত দিয়ে খামচে ধরলে ছুটাতে কিন্তু তোমার খবর হয়ে যাবে। চাইলে অবশ্য মাছ ধরার চেষ্টা করে দেখতে পারো। অনেক মাছই পাওয়া যায় এখানকার নদীতে। আর লোনা পানিতে গোসল করতে না চাইলেও সমস্যা নেই। নদীর তীরগুলো এতো সুন্দর, সেখানে তোমার সারাদিন বসে থাকতে ইচ্ছে করবে। জোয়ারের পানি চলে যাওয়ার আগে বালুময় মাটিতে নানান নকশা এঁকে যায়। আর তার মাঝে একটু একটু পানি জমে সেই নকশাকে করে তোলে আরো জীবন্ত। তাকে আবার ছোট ছোট কচি সবুজ ঘাস রঙীন করে তোলে। আর রাতে নদীর তীরে যেতে পারলে তো কথাই নেই। পূর্ণিমা হলে সারারাত চাঁদ দেখেই কাটিয়ে দিতে পারবে। আর অমাবস্যা হলে ভুতের গা-ছমছম করা গল্পের আসর যে দারুণ জমবে তা কি আর বলতে হয়!

নদীগুলোর মজা কিন্তু এখানেই শেষ না, বনের ভিতর চিকন চিকন খাল হয়ে ঢুকে গেছে নদীগুলো। একটা আরেকটাকে জড়িয়ে ধরেছে প্রাণের বন্ধুর মতো। এইসব খাল ধরে তুমি চলে যেতে পারবে বনের অনেক ভিতরে যেখানে হরিণ থাকে। সেজন্য অবশ্য তোমাকে ট্রলার ভাড়া করতে হবে। তবে ওগুলো নামেই ট্রলার। আসলে কিন্তু তোমাকে একটা মাছধরা নৌকাতে করে নিয়ে যাবে। তাতে অবশ্য ভয়ের কিছু নেই। নৌকাগুলো উল্টে যাওয়ার কোনোই সম্ভাবনা নেই।

এখানে এলে একদিন অবশ্যই এমনি কোনো নৌকা বা ট্রলার ভাড়া নিয়ে বের হয়ে যাবে নদী ভ্রমণে। নৌকা নিয়ে নদীতে ঘোরার মতো আনন্দের কাজ আর কী আছে বলো?
হরিণ হয়ে যায় ‘ফড়িং!

দারুণ একটা মজা হবে যদি তোমরা ওখানকার লোকদের জিজ্ঞাসা করো হরিণের কথা। তুমি হয়তো জিজ্ঞাসা করলে, ‘হরিণ দেখা যাবে কোন দিকে?’ উত্তর এলো, ‘ফড়িং দেখবেন? তাইলে আপনারে ঐ বনে যাইতে হইবো।’ আকাশ থেকে পড়ে যেও না। ওখানকার মানুষরা ‘হ’ কে বলে ‘ফ’ আর ‘ণ’ কে বলে ‘ং’। তাই ‘হরিণ’ হয়ে যায় ‘ফড়িং’।

হরিণ অবশ্য গভীর বনে না গেলে দেখতে পাবে না। গভীর বনে যেখান দিয়ে ঢুকতে হবে, সেটা কিন্তু বেশ মজার একটা জায়গা। তিনদিকে বন, মাঝখানে ফুটবল খেলার মাঠের মতো বিশাল জায়গায় কোনো গাছই নেই। সামনে যেখানে পানি সেখানেও গভীরতা খুবই কম। ডাঙা থেকে অনেক দূর চলে আসার পরও দেখবে পানি তোমার কোমরের কাছেও আসেনি। তবে নৌকা থেকে নেমে হাঁটার সময় একটু সাবধানে পা ফেলবে কিন্তু। ওখানকার মাটি এতোই পিচ্ছিল, যে পা ফেলতে একটু এদিক ওদিক করলেই ধপাস করে পড়ে যেতে হবে। আর ভুলেও স্যান্ডেল পরে হাটতে যেও না। অবশ্যই স্যান্ডেল খুলে হাতে নিয়ে নেবে। কেডস পরলে সেটাও। নয়তো স্যান্ডেল মাটিতে যাবে আটকে। আর সেটা তুলতে গিয়ে তুমি ঠিকই সেটা ছিঁড়ে ফেলবে। তখন তুমি ভীষণ বিপদে পড়ে যাবে। কারণ বনের ভিতর আবার স্যান্ডেল না পরে হাঁটা খুবই বিপদজনক। শ্বাসমূল নয়তো কেওড়া গাছের ডাল তোমার পায়ের নিচে পড়বেই। তখন শুধু যে ব্যথা পাবে তাই নয়, কেটেও যেতে পারে।
সেখান দিয়ে বনে ঢোকার সময়ই হয়তো হরিণের পায়ের ছাপ দেখতে পারবে। ছোটো ছোটো দুটো খূরের পাশাপাশি দুটো গোলগোল দাগ। এখানে হরিণ আসে অনেক রাতে, পানি খেতে। তারপর হয়তো হরিণের দু-একটা কঙ্কালও দেখতে পাবে। নিশ্চই ভাবছো, নিঝুম দ্বীপে বাঘ নেই শিয়াল নেই তারপরও হরিণ খেলো কে? হরিণগুলো খেয়েছে কুকুর। কি বিশ্বাস হয় না? এখানকার কুকুরগুলো সুযোগ পেলেই হরিণ মেরে খায়। তবে সহজে পারে না। কারণ হরিণ খুবই সতর্ক প্রাণী। আর দৌড়াতেও পারে বেশ।

বনের মধ্যে বেশ খানিকটা ভেতরে গেলে তবেই হরিণের দেখা পাবে। তবে সেক্ষেত্রে তোমাদেরকে খুবই সতর্ক থাকতে হবে। কারণ হরিণ যদি তোমার পায়ের শব্দ পায়, ভোঁ দৌড় দেবে। তবে হরিণের পালের দৌড় দেখাও বেশ মজার ব্যাপার। চিন্তা করে দেখো, একপাল সোনালি রঙের হরিণ দূর দিয়ে দৌড়ে যাচ্ছে আর তুমি গাছের আড়াল থেকে তা দেখছো। ফিরে এসে তোমার বন্ধুদের কাছে বেশ জমিয়ে হরিণ দেখার গল্প করতে পারবে কিন্তু। চাইলে হরিণের পিছে দৌড়াতেও পারো।
তবে ভুল করেও কিন্তু গ্রীষ্মকালে নিঝুম দ্বীপে যেও না। তোমার যাওয়ার আসল মজাই নষ্ট হয়ে যাবে। তখন বনে গিয়ে হরিণ দেখবে কী! ভিতরে ঢুকে দাঁড়াতেই পারবে না। মশা পারলে তোমাকে তুলে নিয়ে যাবে। কিন্তু তুমি যদি আবার শীতকালে যাও, তখন কোনো মশাই থাকবে না। মশাগুলো শীতকালে যে আসলে কোথায় যায় সেটাও এক বিশাল রহস্য!

তাহলে আগামী শীতেই নিঝুম দ্বীপে গিয়ে হরিণ দেখার পরিকল্পনাটা করে ফেলো দেখি। বনের মধ্যে মুক্ত হরিণ দেখার মজাই আলাদা। বিশ্বাস হচ্ছে না? স্বচক্ষে একবার দেখে আসো তবেই বুঝতে পারবে।

Blogger templates

.
Recommended Post Slide Out For Blogger